বাওকুমটা বাতাস যেমন (পর্ব ১)

❑  সুবীর সরকার

যে হাট থেকে ফিরে গিয়েছিলেন আলাউদ্দিন এম এল এ সেই হাট থেকেই তো শুরু হতে পারে নুতন কোন গল্প। অথবা হাটের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে চিরকালের কোন আখ্যান। এটাই তো হয়ে থাকে।পুরোন গল্প সরে সরে যায়। নুতন গল্প ধল্লা নদীর বগা বগির কান্নার সুরে সুরে দুলে ওঠে। একটা পুরাতন পৃথিবী থেকে মরিচ ক্ষেতের মধ্য থেকে উড়ে আসে
গানের কলি—
ও রে কামালউদ্দিন ভাই
টাকা নাই পয়সা নাই
বিয়াও করিলু ক্যান

চিলমারীর বন্দর থেকে ভরা হাটের গন্ধ শরীরে জড়িয়ে ঘরের রাস্তায় পা ফেলেছিল ইয়াকুব মুন্সি।
আজ ছিল চিলমারীর হাট। অনেকদিন বাদে নাগেশ্বরী থেকে এসেছিল দোস্ত রফিকুল। সারা হাট
ঘুরে ঘুরে দুই বন্ধুর খুব ফুর্তিতে কেটেছে আজ।
চিলমারীয়া চিকন চিড়া আর গামছাবান্ধা দই খেতে খেতে পুরোন সময়ের কত গল্প।

একবার কৃপাসিন্ধু গীদালের দলের পালাগান শুনতে তারা গিয়েছিল ভুরুঙ্গামারি। সারা রাত গান শুনে ভোরবেলায় তারা আবিষ্কার করেছিল পালার যে সুন্দরীকে দেখে তারা উন্মনা হয়েছিল রাতে, আসলে সেই সুন্দরীর মুখ ভরা বড় বড় গোটার ক্ষত।
তারপর দুজনেই দমফাটা হাসি হাসতে হাসতে বলে উঠেছিল—
রাইতোত দেখোং সোনার বালা
দিনত ক্যানে মুখত গোটা

তখন কারোর বিয়েশাদী হয় নি। ফাঁক পেলেই ঘুরে বেড়ানো দুই বন্ধুর। মনে আছে এই চিলমারীর বন্দরেই তারা শুনেছিল কছিমুদ্দিনের গান।
ফেরার পথে এত সব পুরাতন স্মৃতি ইয়াকুব মুন্সীকে তাড়া করছিল। জাপটে ধরছিল।
তখন হিন্দুস্থান পাকিস্থান হয় নি। তখন ব্রিটিশের শাসন।ধল্লা নদীর পাড়ে ঘন জঙ্গল। দিনেই বাঘ বেরিয়ে আসতো। বড়বাবার মুখে গল্প শুনেছে ইয়াকুব এখানে শিকার করতে আসতেন তাজহাট জমিদার গোবিন্দ লাল রায়। মুন্সীবাড়ির বড় হুজুর।
 
কুপির আলোয় ভাত খেতে খেতে বড়বাবা আরো শোনাতেন নুরুলদিনের সেই যুদ্ধের কথা।
 
কুচবিহারের সেই মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপের গল্প।
 
তখন দিনকাল অন্যরকম ছিল। তখন দেশ দুনিয়ায় কত কত গান ছিল। মাঠে মাঠে নাচ ছিল। আইলে আইলে ছিল আইল কাশিয়া।

কুড়িগ্রামের হলদিয়া পাখি উড়ে উড়ে জলপাইগুড়ি চলে আসে। তাদের ডানার ছায়ায় ছায়ায় কি তীব্র এক মায়া। তিস্তার জলে ছায়া বিছিয়ে দিয়ে সেই পাখি ঢুকে পড়ে পাটগ্রামে। পাখিটিকে তবে তো বলা যেতেই পারে সোনার বরণ পাখি! পাখির এই যাতায়াতের মধ্য দিয়ে পুরনো কোন গল্প কখনো ছিটকে চলে আসতেই তো পারে নদী জঙ্গল বাড়ি টাড়ির মাঝখানে। গল্প বৃত্তাকারে গড়াতে থাকে।

খোলানে শোনা যায় ঢেঁকির শব্দ। সঙ্গে গুনগুন গানের সুর। তিন বউ ধান ভানছে ঢেঁকিতে।রুপশালি ধান। ঢেঁকি ওঠে ঢেঁকি নামে। একটা অদ্ভুত ছন্দ। আর তিন বউ সমস্বরে গাইতে থাকে—
ও তুই একবার আসিয়া সোনার চান
যাও মোক দেখিয়া রে

এই গান চোখে জল এনে দেয়। বুকের খুব মধ্যিখানে খুব খুব মায়া জন্মাতে থাকে। তিন বউ ধান ভানে। তিন বউয়ের গানের সুর আসন্ন জ্যোৎস্নায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বড্ড মায়াবী এই দৃশ্যকে চিরকালীন করে তোলে রূপশালি ধানের সুঘ্রাণ।

ঝাম্পুরা কুশানি যখন সিন্দুরমতির মেলা থেকে তার দল নিয়ে তুশভান্ডারের জমিদারবাড়ির আঙিনায় এসে পৌঁছল তখন প্রায় সন্ধ্যে। চড়কের মেলা জমে উঠছে। দল বেঁধে মানুষজনেরা আসছে। তিন দিনের এই জমিদারবাড়ির মেলায় পালা যাত্রা গান মুখোশ নাচ এসবের মস্ত আয়োজন থাকে। দিনহাটা গীতালদহ হয়ে ঝাম্পুরা কুশানি প্রতিবার চলে আসেন এই মেলায় কুশান গানের পালা গাইবার জন্য। ঝাম্পুরা ১০০/১৫০ মাইল জনপরিধির ভেতর একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় গিদাল। মানুষ তার গান শুনে আহ্লাদিত হয়। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি ঝাঁকিয়ে সে যখন পালা গাইতে থাকে তখন চারপাশের পৃথিবীতে নুতন কোন গল্প নুতনভাবে জন্মাতে থাকে।

রাতের পর রাত পালা নিয়ে গঞ্জ জনপদে ঘুরে বেড়ায় ঝাম্পুরা কুশানি। একসময় গান ফুরায় নাচ ফুরায় হর্ষ বিষাদ ফুরায়। কিন্তু মানুষের শরীরের খুব ভেতরে জেগে থাকে গান—
শ্যাম কালা ওরে শ্যাম কালা
ছাড়িয়া দে মোর শাড়ির কানি যায় বেলা

এত কিছু ঘটে যায়। এত কিছু ঘুরে ফিরে চলে আসে।
আর গল্পের রেখা ছুঁয়ে হেঁটে যেতে থাকে ইয়াকুব মুন্সী তার স্মৃতি বিস্মৃতি স্মরণ বিস্মরণ নিয়ে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ