চিত্র: হুমায়ুন আজাদ |
▇ ড. আশুতোষ বিশ্বাস
হুমায়ুন আজাদ, বাংলাদেশের তথা বাংলাভাষী যে কোনো কবিতাপ্রিয় পাঠক-মানুষের কাছে খুব চেনা একজন কবির নাম। আমরা পাঠকেরা হুমায়ুন আজাদ এই নাম শ্রবনেই কাকতালীয়ভাবে ইতিহাসের সেই মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাববের পুত্র হুমায়ুনের কথা আমাদের মনে পড়ে যায়। সম্রাট হুমায়ুন একজন দৃঢ়চেতা শাসক ও যোদ্ধা তাঁর কর্মশৈলি ও বিচক্ষণতা দিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যকে কালের কপোলতলে শুভ্রতায় সমুজ্জ্বলিত করতে পেরেছিলেন। এই মুঘল শাসককের পিতৃত্বকে রূপক-প্রতীকে বিশ্বজনীন আবহে নিয়ে এসেছেন কবি শঙ্খ ঘোষ তার ‘বাবরের প্রার্থনা' কবিতায়। আধুনিক কবি শঙ্খ ঘোষের ‘বাবরের প্রার্থনা’-র উদাহৃত সন্তান হুমায়ুনকে বাঙালি পাঠক কোনোদিন ভুলতে পারবে না। কবিতায় একজন সত্যিকার রক্তমাংসে স্পন্দমান পিতার কন্ঠস্বর সম্রাট বাবরের মুখ থেকে উঠে এসেছে। মানুষকে হত্যা করে রাজ্যের পর রাজ্য জয়কারী একজন দৌদন্ডপ্রতাপ যোদ্ধাও যে একজন স্নেহবান পিতা! সেই পিতার আকুতি, সারা জাহানের সমস্ত পিতার মতোই—“এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম/ আজ বসন্তের শূন্য হাত-/ ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও/ আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।”, আমাদের এই কবিও সেরকমই তার কবিতার অঙ্গনকে শ্রেষ্ঠত্বের সীমারেখায় নিয়ে গেছেন এবং অবশ্যই অনায়াসে নিজের ক্ষেত্রে তিনি ‘আজাদ’—মুক্ত বিহঙ্গ, আর এই কারণেই তিনি একই সঙ্গে সমালোচকনন্দিত-নিন্দিত-প্রথাবিরোধী আবার প্রথানুগত। হুমায়ুন আজাদের নাম সম্পর্কে সমালোচকের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য—“One can think of no more iconic a name than "humayun Azad': Azad meaning freedom, Humayun one of the most famous of Mughal emperors. But Azad was aware of the double sideness of ambition, especially poetic ambition. In Epitaph, he describes a poet being both loved and hated by wives, concubiness, and lovers, in what is a gem of not only considerable humor but piercing insight: the things that makes us potentially great also make us potentially intolerable."2
হুমায়ুন আজাদ ২৮ এপ্রিল ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে অধুনা বাংলাদেশের বিক্রমপুরের কামারগাঁয় জন্মগ্রহন করেন। তাঁর জন্মসময়টি খাতাকলমে অবিভক্ত ভারত ভূখন্ডেই। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে সেটা পুরোপুরি সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। তাঁর পিতা আবদুর রাসেদ, মাতা জোবেদা খাতুন। পিতা স্কুল শিক্ষক ছিলেন, পরে তিনি তার জীবিকা পরিবর্তন করেন, মাতা সব সময়ের জন্য তাদের পরিবারের গৃহকত্রী। হুমায়ুন আজাদের জীবন ইতিহাস থেকে জানা যায়-তাঁর পুর্বনাম ছিল হুমায়ুন কবীর। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে কোর্টে নাম-পরিবর্তনের আইনানুগ পদ্ধতিতে তার পরিবর্তিত নাম হয়ে যায় হুমায়ুন আজাদ। ছোটোবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন দুটোতেই তার অর্জিত ফল ছিল প্রথম শ্রেণি। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে, তারপর সেখান থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা। সেখান থেকে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে স্কটল্যান্ড, সেখানকার এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে গবেষণা করে পি-এইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর দেশে ফিরে আসার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তাঁর লেখা প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা দশটি, তেরোটি উপন্যাস, বাইশটি সমালোচনামূলক গ্রন্থ, আটটি কিশোর সাহিত্যসহ সব মিলিয়ে ষাটের বেশি গ্রন্থ। সেই গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—‘ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল’, (১৯৯৪), ‘নারী’, (১৯৯২), ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’, (২০০১), 'সব কিছু ভেঙে পড়ে’, (১৯৯৫), ‘মানুষ হিসেবে আমার অপরাধসমূহ', (১৯৬০), 'রাজনীতিবিদগণ’, (১৯৯৮), ‘কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ’, (১৯৯৯), ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ', (২০০৪), ‘একটি খুনের স্বপ্ন', (২০০৪), ‘অলৌকিক ইস্টিমার’, (১৯৭৩), ‘জ্বলো চিতাবাঘ’, (১৯৮০), 'সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’, (১৯৮৫), ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই উপরে যাই নীল’, (১৯৮৭), ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’, (১৯৯০), ‘আধুনিক বাংলা কবিতা”, (১৯৯৪) ‘শুভব্রত, তাঁর সম্পর্কিত সুসমাচার’, (১৯৯৭), 'নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’, (২০০০), 'ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ”, (২০০১), ‘মহাবিশ্ব, (২০০০) ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’, (২০০১), 'আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম', (২০০৩), 'কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু’, (১৯৯৮), ‘পেরোনোর কিছু নেই', (২০০৪), 'জাদুকরের মৃত্যু', (১৯৯৭), ‘বাংলাভাষার শত্রুমিত্র', (১৯৮৩), ‘হুমায়ুন আজাদ কাব্যসংগ্রহ', (১৯৯৮, ও ২০০৫), প্রভৃতি। ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’, (১৯৮৫), ‘আব্বুকে মনে পড়ে’, (১৯৮৯) এই গ্রন্থদুটি জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। হুমায়ুন আজাদের কবিপ্রতিভার সুস্মেল দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল,ভাষার ব্যারিকেড মাড়িয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রিক ভাষায়।
উল্লেখ্য,১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নারীবাদী গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘নারী’ নামেই প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা বাংলাদেশে ব্যাপক আলোড়ন পড়ে যায়। ১৯৯২-এ ‘নারী' বেরোনোর পর, পর-পর তিনটি সংস্করণ এবং এর বহু মুদ্রণ প্রকাশিত হয়ে যায়। এটা কিন্তু একজন লেখকের পক্ষে খুবই আনন্দের বা গর্ব করার মতো বিষয়। এই গর্বিত অনুভূতি উপভোগ করার মধ্যেই আচমকা বাংলাদেশ সরকার ১৯ নভেম্বর, ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। কিন্তু সাড়ে চার বছর পর বংলাদেশের উচ্চ বিচারালয় আবার রায়দান করেন যে ‘নারী’-র ওপর নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণ অবৈধ ছিল। উচ্চ বিচারালয়ের যুগান্তকারী এই রায়দানের ফলে স্বাধীন ও বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার জয় জয়কার সূচিত হলো। এইদিক থেকে হুমায়ুন আজাদ অবশ্যই এক স্বাধীন চিন্তা প্রদর্শকের মাইলস্টোন হয়ে থাকলেন পৃথিবীর সৃষ্টিশীল মানুষদের কাছে একজন আধুনিক সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে। এই গ্রন্থে হুমায়ুন আজাদ তুলে ধরেছিলেন তার কল্পনাবিহারী কোনো আবেগাপ্লুত মন গড়া গল্প নয়, তুলে ধরেছিলেন আমাদের বহুদিনের পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতায় নারীর অবস্থান। নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, পুরুষ-ই তাকে নারী তার কামসঙ্গী, তার পরিচারিকা বানিয়ে রাখে নিজের প্রয়োজনে। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টানধর্মের দৃষ্টিতে নারীর অবস্থান, নারী সম্পর্কে সেই সব ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে হুমায়ুন আজাদ আধুনিক সময়ের নিরিখে দাঁড় করিয়ে বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও দর্শনের আলোকে—এই বিশ্বে যা কিছু ভালো বা মন্দ, মহানুভবের মতো যা কিছু আছে সব কিছুর মধ্যেই অর্ধেক নারী আর অর্ধেক পুরুষের কৃতিত্বকে তিনি নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছেন। নারীকে নন্দিত করে বন্দনা করার জন্যই হুমায়ুন আজাদ দেশের মৌলবাদী চিন্তকদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন চক্ষুশূল। মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারণা থেকে সরে আসতে না পারলে কোনো সভ্যতারই মুক্তি হতে পারে না। শুধুমাত্র একটি—‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হয়েছে', বলে কোনো সৃষ্টিশীল গবেষণাকর্ম হয়ে যাবে অপাঠ্য, দেগে দেওয়া হবে ‘নিষিদ্ধ’ তকমা, এই কাজ অতি সহজ হলেও তা মেনে নেওয়া আর যাই হোক সাহিত্য-সভ্যতা যে প্রগতির দিকে যাচ্ছে সে রকম দিক নির্দেশ করে না। হুমায়ুন আজাদ একজন নির্ভীক সৃষ্টিশীল কবি-সাহিত্যিক। ধর্মীয় গোঁড়ামিহীন, নিজস্ব অর্জিত-অনুশীলিত জ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে বিচার করার মতো ঋজু দার্ঢ্য মগজমিটার নিয়ে সর্বদা উজ্জ্বল। যুক্তিহীন যে কোনো বিষয়কে চড়া সুরে বিরোধিতা করার মতো কণ্ঠপেশি নিয়ে সামরিক বা একনায়কতন্ত্রের যত্রতত্র বিরোধিতা করেছেন। স্পষ্ট বক্তা তা সে নারীবিষয়ক হোক বা যৌনতা নিয়ে হোক। তার নিজস্ব রাজনৈতিকচেতনা বা ধর্মীয় চেতনাকে তার সমকালে ব্যক্তি তথা সাহিত্যকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। আর এই জন্যই তিনি তার সমকালে প্রথাবিরোধী কবি বা সৃষ্টিশীল মানুষ বলে প্রচারিত। হুমায়ুন আজাদের ঋজু, তাঁর অধীত জ্ঞানশলাকার উজ্জ্বল আলোকশিখায় সেদিন সমাজের অনেক অন্ধকারময় স্থান, সামাজিক ক্ষতচিহ্নগুলো সর্বসমক্ষে বেআব্রু হয়ে যাচ্ছিল বলেই, ধর্মীয় তথা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁর জীবনদীপ নিভিয়ে দেবার প্রচেষ্টাও করেছিল ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে। যাইহোক তিনি প্রতিপক্ষের প্রথম আঘাতে বেঁচে গেলেও পরের বার আর হয়তো শারীরিকভাবে বাঁচেন নি, কিন্তু আজ তাঁর মনন-প্রধারা শত মশালে শতধারায় দীপিত। তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কার সারণির মধ্যে আছে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’, (১৯৮৬), ‘অগ্রণী ব্যাঙ্ক-শিশূ সাহিত্য পুরস্কার’, (১৯৯৬), “মার্কেন্টাইল ব্যাঙ্ক পুরস্কার', (২০০৪), এবং তাঁর মরণোত্তর ‘একুশের পদক', (২০১২)।
হুমায়ুন আজাদ একই আধারে যেমন একজন খ্যাতিমান কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক, কিশোর সাহিত্য রচয়িতা আবার তেমনি একজন ভাষাতাত্ত্বিক তথা ভাষাবিজ্ঞানী। বাংলা সাহিত্যের প্রায় সমস্ত অঙ্গনেই তাঁর অবাধ গতায়তি। বলতে দ্বিধা নেই তিনি একজন স্বাতন্ত্রধর্মী লেখক এবং এমন এক মৌলিক ধারা তিনি সৃষ্টি করেছেন যে ধারা তার একান্ত নিজের। নিজে সেপথে সবার আগে পথচলা শুরু করেছেন, আর এই নতুন পথের জন্য প্রথাগত রচয়িতারা তাঁকে বলেছেন প্রথাবিরোধী লেখক। “তিনি যথার্থই ছিলেন প্রথা বিরোধী লেখক। নতুন চিন্তার সন্নিবেশ, বক্তব্যের ঋজুতা, বিষয়ের অভিনবত্ব তাকে প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তার স্পষ্টবাদিতা আমরা সেই সময়ই লক্ষ করেছি। প্রখর যুক্তি আর বক্তব্যের ঋজুতার জন্য, আমরা অনুজরা তো বটেই, তার বন্ধুরাও তাকে সমঝে চলতেন।”৩ —এই অভিজ্ঞান ফারুক মাহমুদের। ২৮এপ্রিল হুমায়ুন আজাদের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর স্মৃতিচারণামূলক এই অভীজ্ঞা, ‘ভোরের কাগজ' সংবাদপত্র পাঠকের সংবেদনায় নতুন করে কাফনের অশ্রুবিন্দু খুলে দেখার মতো করে আমাদের নতুন করে ভাবায়। হুমায়ুন আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩) খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল।
এই প্রথম গ্রন্থেই হুমায়ুন আজাদ সকলের নজরে চলে এলেন—তার নিজস্ব বাক স্বাতন্ত্র্য ও বক্তব্যের স্পষ্টতায়। সাতের দশকে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলেও নয়ের দশকে ঔপন্যাসিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। আবার কিছু কুচুটে সমালোচক হুমায়ুন আজাদের এই প্রথম কাব্যগ্রন্থেই আমাদের বুদ্ধদেব বসুর প্রভাব খুঁজে পেতে শুরু করলেন। যাইহোক, ১৯৭৩ সালে হুমায়ুন আজাদের লেখার মধ্যে পাঠক সাধারণের বুদ্ধদেব বসুকে খুঁজে পাওয়ার মধ্যে আর যাইহোক বাংলা কবিতা-পাঠক বুদ্ধদেব বসুকে আত্তীকরণেও যে পৌঁছেছে তা ভাবতে ভালো লাগে! হুমায়ুন আজাদ বাংলা কবিতায় এনেছেন বহুমাত্রিকতা। তাঁর কবিতা তাঁর জীবন রস-আঘাতে আঘাতে জীবনকে চিনে নিয়ে, তাকে কবিতায় পর্যবেশিত করার এক সৃজনীমাধ্যম, আর তাই তিনি বেশি বেশি তার কবিতা-প্রেয়সীর কাছে আরো বেশি দায়বদ্ধ। তার কবিতার ভাষা চয়নে তাঁকে মিশর-সিংহল-সমুদ্র-ঝাঁপাতে হয় নি, সবই তার যাপিত জীবনের তাপিত অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। “প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে তিনি পাঠকের হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই পেয়েছেন। ভাস্বর হয়ে আছেন বাংলা সাহিত্য জগতে। আমৃত্যু তিনি প্রথাবদ্ধ কুসংস্কারচ্ছন্ন পশ্চাদমুখী সমাজ-রাষ্ট্রের বদ্ধ শিকল থেকে মানুষকে মুক্তবুদ্ধির জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন করতে চেয়েছিলেন।”৪ সময় তার কবিতার প্রধানতম এবং একতম নায়ক। নিজের স্বদেশ, নিজের স্বদেশিয় প্রকৃতি তার কবিতার প্রধান অবলম্বন। অন্যান্য বাংলাভাষী সমাজসচেতন কবিদের মতোই একজন দায়বদ্ধ কবি হিসেবে তিনিও স্বপ্ন দেখেছেন তার স্বদেশ হোক স্বনির্ভর, আর শোষণমুক্ত। নিজের মনন আর মেধা দিয়ে বুঝে নিতে ও সংক্রামিত করে দিতে চেয়েছিলেন তার এই উপলব্ধিত বোধ আপামর স্বদেশবাসীকে।
একেবারে আঙুল তুলে চোখে চোখ রেখে সভ্যতার পিলসুজদের বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন— যারা হয়তো এখনো বুঝে ওঠে নি, তারা কী ও কেন আর তারা উৎপাদনের নামে কি উৎপাদন করছে?
“ঘামে গোশল করা, কালিঝুলি মাখা আমার শ্রমিক বন্ধুরা,
আমার আদমজির বন্ধুরা,
ডেমরার বন্ধুরা,
টঙ্গির বন্ধুরা,
খলিশপুরের বন্ধুরা,
আপনাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে।...
আপনারা কি জানেন আপনারা শোষণ উৎপাদন করছে?
আপনাদের বলা হয় আপনারা উৎপাদন করছেন সম্পদ।
কিন্তু আপনারা কি জানেন কী ভয়াবহ, নিষ্ঠুর,
দানবিক সম্পদআপনারা উৎপাদন করছেন ক’রে চলেছেন শরীরের রক্ত
ঘামে পরিণত করে? বন্ধুরা, প্রিয় শ্রমিক বন্ধুরা,
আপনারা দিনের পর উৎপাদন করে চলেছেন শোষণ।”৫
হুমায়ুন আজাদ বাঁধাগতের বাইরে চলার মতো দঢ়ো মানসিকতা রাখতেন, তিনি হয়তো অনুভব করেছেন—বাঁধা গৎ-এর জীবন মানে গড্ডালিকা প্রবাহে বাহিত জীবন, এইরকম জীবন তো আমরা বহুদিন বহুকাল ধরে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি, হয়তো এখনো চলছি। চলতে চলতে সড়কে তার ছাপ পড়ে গেছে, সেখানকার দুর্বো ঘাসগুলি পর্যন্ত মরে গেছে, সেই একই পথে চলতে আর কি তাতে রোমাঞ্চ আসে!যদি না নতুন করে পথ কেটে নতুন পথ বানালাম।হুমায়ুন আজাদ নিজেই তার কবিতা রচনার আন্তপ্রেরণা হিসেব নিজের মতামতকে স্পষ্ট করেছিলেন—“তাদের সাথে আমার ভিন্নতা বিষয়ে, ভাষায়, সৌন্দর্যের তীব্রতায় ও শিল্পকলাবোধে। আমার কবিতার স্টাইলে দেখতে হবে এর ভাষা ব্যবহার, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন এর ছন্দ মানা ও না-মানা;এর কল্প-রূপক প্রতীক ও স্টাইলের অন্তর্ভূক্তি। আমি অনেক ক্ষেত্রে ছন্দ মানার জন্য ছন্দ মানি নি, যদি দেখেছি যে ছন্দের কবিতার মধ্যেও মাত্রা মিলিয়ে ছন্দটি কৃত্রিম মনে হচ্ছে, তখন আমি তা মানি নি। স্তাবকবিন্যাস, চিত্রকল্প রচনা পদ্ধতি, রূপক তৈরির পদ্ধতি, ভেতরে তো চেতনা রয়েছেই। আমি কবিতায় বানানো পাগলামো বাতিকগ্রস্ততা, আবোলতাবোল বকা পছন্দ করি না। হেয়ালি পছন্দ করি না, আমি কবিতাকে নিটোল কবিতা করতে চেয়েছি, আর আমার কবিতায় রয়েছে আধুনিক চেতনা। আমার দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনও কবিতার অংশ। ভাবালুতা আমার দেশে খুব প্রিয়, আমি তা করি নি। ওগুলো গাল ফুলিয়ে পড়ার জন্য।”৬
তাহলে দেখা যাচ্ছে হুমায়ুন আজাদ আধুনিক বাংলা কবিতা সম্পর্কে কতটা ওয়াকিবহাল ছিলেন। আর সেই বাংলা কবিতার দুর্বলতাকে দূর করার জন্য আগে থেকেই তিনি প্রস্তুত। তিনি ‘বাছা বাছা ভুল’-গুলোকে বেছে বেছেই সঠিক করার চটজলদি প্রেরণা অনুভব করেছিলেন। বাংলাদেশের বাংলা কবিতাকে সাবলীল করার আত্যান্তিক বোধ অনুভব করেছিলেন। আর সেই কাজ করেছিলেন বলেই তিনি হয়ে গেলেন প্রথাবিরোধী কবি। সময়ের বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট কথা বলতে গেলে দম থাকা চাই। গতানুগতিকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকতে গেলে বুকের পাটা অনেক ইঞ্চি চওড়া হওয়া চাই। হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে আগেই মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার নামের মধ্যেই একটা সাম্রাজ্যের হুমায়ুনী গরিমা যেমন ছিল তেমন ছিলো ‘আজাদী’ বা মুক্তচিন্তা আর প্রথাবিরোধী ভাবনার ব্যঞ্জনা, না হলে তিনি কোন আহ্লাদে হুমাউন কবীর থেকে কেন হুমায়ুন আজাদ নামটিকে বেছে নেবেন! তার কবিতা একাকী-পাঠকের বা একাকী গায়কের বিলাসী সৃজন-প্রক্রিয়া নয়। তার কবিতায় অন্তর্ভূক্ত হয়ে আছে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের মানুষের হৃদপিন্ডের লাব-ডাব ধ্বনিঝঙ্কার। ছাপান্ন হাজার বর্গ মাইল বিস্তৃত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের ভালো-মন্দ, দুঃখ-কষ্টের দিনগত পাপক্ষয়ের মুক্তির বারতা। সমগ্র বাংলাদেশ ভূখন্ডের আর্থিক, রাষ্ট্রিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থার প্রথাগত অবস্থান অবলোকন করে তবেই তিনি হয়ে উঠলেন প্রথাবিরোধী।
“এদেশ বদলে যাবে, বদলে দেবে শ্রমিকেরা, অতীন্দ্রিয় ছাপ্পান্ন হাজার
বর্গমাইল শুদ্ধতা পাবে মিলিত মেধায়। পরিশুদ্ধি পাবে সব কিছু।
পদ্যপুঞ্জ পুনরায় উঠবে কবিতা হয়ে, পরিশুদ্ধ পাঁচটি স্তবকে
শুদ্ধি পাবে সমগ্র রবীন্দ্র কাব্য, একটি ধ্বনিতে ছেঁকে তোলা হবে সমস্ত ঐশী
গীতবিতানের স্বরমালা, যেতে হবে অপেক্ষমান যেখানে ভয়াল মৃত্যু,
নয়তো বা বিশাল বিজয়। জমে যাই তীব্র শীতে জ্বলে উঠি তীক্ষ্ণ
উত্তাপে—আমার সামনে কোনো মধ্যপথ ছিল না–থাকবে না।”৭
কবির কাছে স্বদেশ স্বর্গের চাইতেও সুন্দর। ‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরি’-আর স্মৃতি দিয়ে সাজানো, তার এই স্বদেশকে হৃদয় রামধনুর বহুবর্ণীরূপ দিয়ে সাজিয়ে নিতে ভালোবাসেন। জন্মাদপি গরিয়সি বাংলাদেশকে নিয়ে কবির স্বপ্ন দেখার অন্ত নেই। শুধু কবি কেন বাংলাদেশের সমস্ত নাগরিকরাই তাদের হৃদয়ের আত্যান্তিক বাসনা দিয়েই তাদের দেশজননীকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন এবং গড়েওছেন। কিন্তু,–তবু কবির কাছে এ কোন, দেশ হাজির হলো? ‘এই মৃত্যু উপত্যকা’,-এই লাশের সারি, আর রাতারাতি মত বদলে উলটোপথে হাঁটা, কূট-হৃদয়ের, মিছরির ছুরি মুখে, অবিশ্বস্ত মানুষের ভিড়। এই মানুষগুলো আর যাইহোক—কোনো একটা দেশের শুভঙ্করী মানুষ হতে পারে না।
কবির স্বদেশে আজ কী তবে এসে গেল ‘পবিত্রস্থান' নামের মতো ব্যঞ্জনাবাহী কোনো দেশের অপবিত্র স্পর্শ!অন্তত হুমায়ুন আজাদের কবিতায় পাঠক সেই ভিড়ে ঠাসা আততায়ী বা জামার আস্তিনে লুকিয়ে চপারে হাত রাখা ছদ্মবেশী বন্ধুর ছায়া পেয়ে যান। এইরকম ভাবে একজন দায়বদ্ধ কবি আমাদের সকলের অজান্তেই দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠেন—সত্যিকার নাগরিক হয়ে ওঠেন। আর হয়ে ওঠেন সেই আততায়ীদের চোখের কাঁটা,তাদের বন্দুকের নলের লক্ষ্যবস্তু! আমরা প্রায় এইরকমই চলচ্চিত্রের চিত্রনাটকের মতো প্রথাবিরোধী কবি কবি হুমায়ুন আজাদের ব্যক্তিগত জীবনেও একইরকম ঘটনা ঘটতে দেখেছি। কবি অনুভব করছেন তার স্বদেশ পরিবর্তিত হচ্ছে একেবারে তার চোখের সামনে-
“আমার চোখের সামনে শহরের সবচেয়ে রূপসী মেয়েটি
প্রথমে অভিনেত্রী, তারপর রক্ষিতা, অবশেষে
বিখ্যাত পতিতা হয়ে উঠল।
এক দশক যেতে না যেতেই আমি দেখলাম
বাংলার দিকে দিকে একদা আকাশে মাথা-ছোঁয়া মুক্তিযোদ্ধারা
কী চমৎকার হয়ে উঠলো রাজাকার।
আর আমার চোখের সামনেই রক্তের দাগ-লাগা সবুজ রঙের
বাংলাদেশ দিন দিন হয়ে উঠলো বাংলাস্তান।”৮
একজন কবির মৃত্যু হলেও তার কবিতা থেকে যায়। তার লেখা কবিতার এক একটি অক্ষর এক একটি মুষল। এক একটি ডিনামাইট। এক একটি আগ্নেয়গোলা হয়ে নিরন্তর আছড়ে পড়ে বিবেকি-মানুষের চেতনায়। কাজেই দৈহিকভাবে কবি তার দেহ নিয়ে এই নশ্বর পৃথিবীতে চিরকাল থাকবেন না। ছোট্ট এ সোনার তরীতে ব্যক্তি মানুষের যেমন স্থান নেই, তেমনি কবিরাও তাদের শরীর নিয়ে পৃথিবীরূপ সোনার তরীতে থাকতে পারবেন না, কিন্তু এই পৃথিবীতে তারা রেখে যাবেন সহস্র সহস্র বছরের জন্য মানুষের বেঁচে থাকার খোরাক। মানুষ কোনোদিন কারও কাছে হারবে না, হারতে পারে না—আর বাঙালি জাতি তো কোনোদিন হারতেই জানে না। হয়তো সাময়িকভাবে ছলা কলা করে কিছু অংশ অপশক্তিরা নিয়ে নেবে, আঁচড়-নখর দেবে। সব কিছু নষ্টদের দখলে, দুর্বৃত্তের দখলে চলে গেলেও শেষ হাসি কিন্তু হাসবে শুভবোধে স্থিত, কোটি কোটি বছর বয়সী প্রাজ্ঞ অভিজ্ঞ এই মানব প্রজাতি। কবি যদিও আজকের দেশের হাল-হকিকৎ দেখে অনুভব করেছিলেন,—‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে চলে যাবে। কী কী যাবে তার একটা ফিরিস্তি যদিও কবি দিয়েছেন—সেগুলির মধ্যে যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যজ্ঞাপক অনিন্দ্যসুন্দর প্রাকৃতিক সম্পদ, শীতের রোদ, পূর্ণিমার চাঁদ, নদীর কুলকুলু ধ্বনি, শ্রাবণ মেঘ, বাঙালির গর্ব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিলোকের অনির্বচনীয় সম্ভার, বেহালা-সঙ্গীতশিল্পীর অপার্থিব তান, কাঁশবন, মেধা-মনন, শহর, বন্দর, ধানক্ষেত, নদীনালা, গিরিপথ, সংঘ-পরিষদ, রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, দলিল-দস্তাবেজ, মন্দির-গীর্জা-মসজিদ সব। এই চলে যাওয়ার সারণিতে আরো আছে সেই সব জিনিস যা আমাদের সভ্যতার ভালোবাসার সৃষ্টি, প্রাণের সম্পদ-
“আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
সবচে সুন্দর মেয়ে দুই হাতে টেনে সারারাত
চুষবে নষ্টের লিঙ্গ; লম্পটের অশ্লীল উরুতে
গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী। চলে যাবে,
কিশোরীরা চলে যাবে, আমাদের তীব্র প্রেমিকারা
ওষ্ঠ আর আলিঙ্গন ঘৃণা করে চলে যাবে, নষ্টদের
উপপত্নী হবে। এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র
শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের ঠোঁট
গদ্যপদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্কস-লেনিন,
আর বাংলার বনের মতো আমার শ্যামল কন্যা-
রাহুগ্রস্ত সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক-
আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে।”
পৃথিবীর সব ভালো ভালো সম্পদ, উপাদেয় চব্য-চুষ্য-লেহ্য সব কিছু নষ্টদের অধীনে চলে গেলেও কবি আশাবাদী—এর বেশি আর কী নিতে পারে আমাদের এই নষ্ট-ভ্রষ্ট সময়ের হাত? ‘তোমার ক্ষমতা’-কবিতায় তারই একটি প্রসাধিত জবাব দিতে হুমায়ুন আজাদ ভোলেন নি। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, পৃথিবীর সেই অমাশক্তি সভ্যতার, সমাজের অনেক কিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারে। শরীরের সমস্ত রক্তরস ও লবন শুষে নিতে পারে। আমাদের ভাবীস্বপ্নগুলোকে অঙ্কুরেই বিষিয়ে দিতে পারে। বন উপবন, রাজপথ যাতায়াতের সিঁড়ি-পথ সব ওলোট-পালট করে দিতে পারে। হৃদয়ের কোণে অনুরণিত গানের সুরে গরল মিশিয়ে দিতে পারে। আত্মহত্যা করাতে প্রাণিত করাতে পারে। বিষ-ইঞ্জেকশন দিয়ে মাতাল বা পাগল বানাতে পারে। রাস্তার সমস্ত সিগন্যাল, রাস্তার বিদ্যুৎ সব বন্ধ করে দিতে পারে। এর পরেও কবির প্রশ্ন—এর বেশি আর কী করতে পারে!অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতোই বলতে হয়—‘রাজছত্র ভেঙে পড়ে/ রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে...শিশু পাঠ্য কাহিনিতে থাকে মুখ ঢাকি।' বিজয়ের হাসি সেই মানুষই হাসবে। কিংবা আমাদের আস্তিক্যবাদী কবি অমিয় চক্রবর্তীর ‘বড়বাবুর কাছে নিবেদন' নামক কবিতায় এই ছাপোষা কেরানীও কী কী কেউ কোনোদিন তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না, নিঃসঙ্কোচে সেই তালিকা প্রস্তুত করেছিল-
“তালিকা প্রস্তুত
কী কী কেড়ে নিতে পারবে না—
হই না নির্বাসিত কেরানি।
বাস্তুভিটে পৃথিবীর সাধারণ স্তিত্ব।
যার এক খন্ড এই ক্ষুদ্র চাকরের আমিত্ব।
যত দিনবাঁচ, ভোরের আকাশে চোখ জাগানো
হাওয়া উঠলে হাওয়া মুখে লাগানো
কুয়োর ঠান্ডা জল, গানের কান, বইয়ের দৃষ্টি
গ্রীষ্মের দুপুরে বৃষ্টি।
আপন জনকে ভালোবাসা,
বাংলার স্মৃতিদীর্ণ বাড়ি-ফেরার আশা।”১০
মানুষের ওপর হুমায়ুন আজাদের সেই অফুরান অনন্ত প্রত্যয়, প্রগাঢ় ভালোবাসা তাঁকে বাংলাদেশের অন্যান্য প্রথিতযশা কবিদের মধ্যে ব্যতিক্রমী করে তুলেছে। আমাদের হাজার বছরের অধিক সময়ের যাপিত বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালি জীবনাচারণ অনায়াসে হুমায়ুন আজাদের কবিতায় স্থান করে নেয়। তাঁর কবিতা অবশ্যই বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের সৌন্দর্যের অপার রহস্যসমুদ্রের অবগাহনজাত হীরামাণিক্যেররশ্মিচ্ছটা বিকিরণ করে। আধুনিক যে কোনো পলায়নবাদী কবির মতোই তিনিও কখনো-সখনো আশ্রয় নেন আমাদের ফেলে আসা অতীতের রহস্যমাঝারে। কারণ তার সন্মুখে উত্তিষ্ঠিত যে মানবসমুদ্রের ঢল প্রবাহমান—তা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বৈপরীত্যে, শূন্যে কম্পিত সোনার বিস্কুট স্পর্শ-দৌড় প্রতিযোগিতার বিস্কুটস্পর্শপ্রচেষ্টায় ব্যস্ত। বাস্তব আর ভাবনার মধ্যে ফারাক হয়ে যায় বিস্তর-
“আমার সব কিছু পর্যবসিত হয়েছে ভবিষ্যতের মতো ব্যর্থতায়,
ওরা ভরে উঠেছে বর্তমানের মতো সাফল্যে।
ওরা যে ফুল তুলতে চেয়েছে, তা তুলে এনেছে নখ দিয়ে ছিঁড়েফেড়ে।
আমি শুধু স্বপ্নে দেখেছি আশ্চর্য ফুল।
ওরা যে-তরুনীকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছে, তাকে জড়িয়ে ধরেছে দস্যুর মতো।
আমার নারীকে আমি পেয়েছি শুধু স্বপ্নে।...
আমি যে পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি। তখনো আমার সময় আসে নি।”১১
‘কথা দিয়েছিলাম তোমাকে’ কবিতাতেও পাওয়া যায় স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের উপল বাতাবরণ। কবি তাঁর প্রিয় মানুষের জন্য কিছু উপকরন-সম্ভার রেখে যাবেন বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু আসলে বাস্তবে তা আর হলো না, আর এর জন্য সারাটি জীবন কবি মনে বিদ্ধ হয়ে থেকেছে এক অস্বস্তির কাঁটা। উল্লেখ্য, কবির ভালোবাসার জন্য কল্পিত যে উপকরন গুলি রেখে যেতে চাইছেন—তা সবই তার বাংলাদেশের মৃত্তিকাশ্রয়ী—
“কথা দিয়েছিলাম তোমাকে রেখে যাবো
পুষ্ট ধান মাখনের মতো পলিমাটি পূর্ণ চাঁদ ভাটিয়ালি
গান উড্ডীন উজ্জ্বল মেঘ দুধের ওলান মধুর চাকের মতো গ্রাম
জলের অনন্ত বেগ রুইমাছ পথপাশে শাদা ফুল অবনত গাছ
আমের হলদে বউল জলপদ্ম দোয়েল মৌমাছি।”১২
কিন্তু আসলে রেখে গেলেন—নষ্টফলে দুষ্ট কীট, পুঁজওয়ালা ধান, দুর্গন্ধযুক্ত পচা তরমুজ, আর স্বপ্নের আতঙ্কভরা বিনিদ্র রাত জাতীয় যত সব অসহনীয় কদর্য, নোংরা আবর্জনার স্তুপ। কবির চেতনায় স্বভাবতই বিদ্রোহ জেগে ওঠে। দেশ ও দশের বুকে চলতে থাকা গতানুগতিক ধারাকে এই কারণেই তিনি ভেঙে ফেলতে উদ্যত হন। একা একায় তায় কবির কথা, শব্দচয়ন ও শব্দ প্রয়োগে অন্যদের থেকে পার্থক্য চলে আসে। কবিকে স্পষ্ট, অপ্রিয় সত্য কথাকে কঠিন সময়ের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে বলতে বাধ্য হতে হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক,সামাজিক, অর্থনৈতিক ঘোরালো অবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে খুব কম মানুষই এরকম কথা বলতে পারেন। মুষ্টিমেয় যে কয়জন বলেছেন— তাদের মধ্যে হুমায়ুন আজাদ অন্যতম। দেশ ও মানুষের মধ্যে ঘটে যাওয়া নানান বিচ্ছিন্ন ঘটনা, দুর্ঘটনাগুলোর সঙ্গে নিবিড়ভাবেযুক্ত থেকে, কবিতার ভাষাকে করেছেন সময়োচিত ও কলরবমুখর।
“কী অদ্ভূত সময়ে বাস করি।
যা কিছু আমি ভালোবাসি তাদের কথাও বলতে পারি না।
বলতে গেলেই মনে হয় আমি যেনো চারপাশের
সমস্ত শোষণ, পীড়ন,অন্যায় ও প্রতিক্রিয়াশীলতাকে
সমর্থন করি।
আর ‘তোমাকে ভালোবাসি’
বলার সময় মনে হয় আমি যেনো ত্রিশ লক্ষ মানুষের
বিশ্বাসঘাতকতা করছি।” ১৩
হুমায়ুন আজাদের—‘বাড়াবাড়ি-রকমের স্বাতন্ত্র্য আর প্রত্যয় তাঁর খ্যাতির মূলে, ক্লাসেও তা টের পাওয়া যেত। তাঁর বাক্যে তীক্ষ্ণতা ছিল। বলার কথাটা আর ভঙ্গিটা প্রতিমুহুর্তেই জানিয়ে দিত, ইনি আর কেউ নন, হুমায়ুন আজাদ।'১৪ —এই মুক্তকন্ঠ উচ্চারণ, একজন ক্লাসে বসা ছাত্রের, তার শিক্ষক সম্পর্কে করবেন তাতে কোনো আশ্চর্য হবার নেই। কিন্তু একজন ছাত্র যখন তার শিক্ষকের মুল্যায়ন করেন—সেটা যদি শিক্ষকের কবিত্ব, শিক্ষকের সাহিত্য সাধনার গঠন ও প্রকৃতি বিশ্লেষণে অগ্রসর হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে সেই শিক্ষক তাঁর মতো শিক্ষায়, তাঁর মতো করে একজন সত্যিকার ছাত্র তৈরি করতে পেরেছেন। এই অভীপ্সা পৃথিবীর সমস্ত শিক্ষককূলেরই থাকে বলেই মনে হয়। এতে শিক্ষকের সঙ্গে সঙ্গে সে-ই ছাত্রের গরিমাও বৃদ্ধি হয়। প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যের অ্যারিস্টটল-প্লেটোর গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক আমরা প্রতিনিয়ত স্মরণ করি। এই দিক দিয়ে মোহাম্মদ আজম এর সঙ্গে সঙ্গে আমরা পাঠকেরা নিঃসন্দেহে একটু আত্মপ্রসাদ লাভ করি। হুমায়ুন আজাদ যে সবসময়ই গতানুগতিক ধারার বিপরীতে চলতেন তার জাজ্জ্বল্য ইঙ্গিত মোহাম্মদ আজম দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নানাবিধ ঘটনায় একজন ছাত্র হিসেবে শিক্ষককে দেখা ও তাঁকে উপলব্ধি অনুভববেদ্যতায় কার্যকারণ ঘটনার বিন্যাসে। মোহাম্মদ আজম তার আলোচনায় স্পষ্ট করেছেন—হুমায়ুন আজাদের মূলত দুটি মননশীল উর্বর এলাকা ছিল, এক–কবিতা, আর দুই–ভাষা। যাইহোক এই দুটিই হুমায়ুন আজাদের কবিতার আন্তর্বিশ্লেষণে প্রধান ভূমিকা নেবে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার ইতিহাস আলোচনায় দেখা যায়,বাংলাদেশের চারের দশক ছিল ইসলামি তথা পাকিস্তানি ভাবধারায় প্রভাবিত এক ‘বাদ’ দ্বারা অভিসিঞ্চিত। এর আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়—১৯৫২'-র ভাষা আন্দোলনের রক্তস্নানে।বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা কবিতা সেলিম-বরকতের রক্তঋণ পরিশোধের এক সুযোগ গ্রহন করে। হুমায়ুন আজাদ অত্যন্ত সুচারুভাবে সেলিম-বরকতের ছবিকে সামনে রেখে বাংলাদেশের বাংলা কবিতায় আনতে পেরেছিলেন নতুন প্রবাহ, বইয়ে দিয়েছিলেন নতুন চেতনার নতুন রক্ত-ভাবস্রোত। এইদিক দিয়ে হুমায়ুন আজাদ প্রথাবিরোধী মানে গতানুগতিকতাকে ভাঙলেন। মোহাম্মদ আজম এই প্রেক্ষিতে জ্ঞাপন করেছেন তাঁর শিক্ষক হুমায়ুন আজাদ পাকিস্তানীবাদকে নাকাল করার জন্য অতিরিক্ত বাহবা পেতে পারেন কিন্তু তাঁকে শুধুমাত্র এই কারণেই প্রথা বিরোধী বলা যাবে না। কারণ বাংলাদেশের পাঁচের দশক পাকিস্তানবিরোধী বা ইসলামি শরিয়ত বিরোধী সাহিত্য রচনায় ঝুঁকেছিল। সত্য, সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ! ভাষাতত্ত্বের তন্নিষ্ঠপাঠ ও গবেষণায় হুমায়ুন আজাদ প্রথাগত ডক্টরেট ডিগ্রিলাভ করেছিলেন, ও ডি বি এল-এর বাইরে নতুন কথা বলেন নি এবং তিনি ছিলেন সবচেয়ে প্রচলিত প্রথাগত মতের সমর্থক-পৃষ্ঠপোষক’। বরং মোহাম্মদ আজম এই ব্যাপারে বেশি উৎসাহী যে হুমায়ুন আজাদ—‘আরবী-ফারসিমূল শব্দের ব্যবহার ও পরিহারকে সাব্যস্ত করেছেন যথাক্রমে প্রতিক্রিয়াশীলতা ও প্রগতিশীলতা হিসেবে। তাঁর সিদ্ধান্ত ভাষাতত্ত্বসম্মত নয়; বাংলা ভাষার ইতিহাসসম্মত নয়; এমনকি সমকালীন বাংলা ভাষার গতি প্রকৃতিসম্মতও নয়। তা সত্ত্বেও, আগেই বলেছি, এটাই ঢাকার কলকাতার নয়— প্রধান মত। আজাদ একরোখাভাবে সে মত উচ্চারণ করার ঝুঁকি নিয়ে ভিন্ন মতাবলম্বীর সম্মান পেয়েছেন।'১৫—একমাত্র এইক্ষেত্রেই আজম তার শিক্ষক হুমায়ুন আজাদের বাংলা সাহিত্যে প্রথাবিরোধিতা লক্ষ করতে পেরেছেন।
হুমায়ুন আজাদের কিছু কবিতা আছে যা কোনোদিন বাঙালি পাঠক হৃদয় থেকে বিস্মৃত হয়ে যাবে না, অন্তত একবার যদি কেউ কবিতাটি পড়েছে বা পড়বে। হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে অনেক ইতিবাচক বা নেতিবাচক কথা বাজারে প্রচারিত থাকলেও—এটা ঠিক হুমায়ুন আজাদ বাংলাদেশের বাংলা আধুনিক কবিতার ইতিহাসে এক প্রথাবিরোধী কবি হিসেবে নিজের অবস্থান সুপ্রোথিত করতে সমর্থ হয়েছেন। তার এই প্রথা বিরোধী সত্তা বাংলা কবিতার এক নতুন মাইলস্টোন। ঠিকই তো ভাষার জন্য, রক্তের বিনিময়ে একটা দেশ অন্তত ভাষার দিক থেকে তার অধিকার অর্জন করে গোটা বিশ্বকে দেখিয়েছে, সেইরকম একটা দেশ তার ভাষা কী হবে তা তো ঠিক করার অধিকার একমাত্র সেই দেশের অধিবাসীদের। এই মৌল সত্য ভুলে গিয়ে অন্য কোনো রাষ্ট্র বা দেশের (নির্ধারকের) ঠিক করে দেওয়া ফরমান—সেই দেশের ভাষা হবে, এই যুক্তি মেনে নেওয়ার মতো সময়ে আমাদের হাজার বছর অতিক্রান্ত বাংলা ভাষা-ভাষীদের ক্ষেত্রে বেমানান, তথা অসম্মানের। হুমায়ুন আজাদ সেই দেশকে সম্মানিত করেছেন যে দেশের ভাষা ‘বাংলা'। ধর্মের ভিত্তিতে কোনো দেশের নাড়ি ছিঁড়ে অন্য ভূখন্ডে জুড়ে গেলেও বাংলা ভাষায় কথা বলি একমাত্র এই শর্তে হুমায়ুন আজাদ নিত্য-স্মরণীয় প্রতিভূ। ভাবতেই ভালো লাগে যখন কোনো কবির কলম থেকে এইরকম কবিতা নিঃসৃত হয়। এই কবিতা একবার আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশের পর আমাদের বাঙালি রক্ত কনিকায় চিরকালের জন্য মুদ্রিত হয়ে যায়। ফুল, ফল, গাছ, নদীচর, সবুজ পাখি, আকাশের নীল, গ্রাম বাংলার কুঁড়েঘর, চিল পাখি, নিশার শিশির, নদীর জল দেখলেই আমাদের মনে হুমায়ুন আজাদের মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে। একজন কবি হিসেবে সেই কবির সার্থকতা তো এখানেই– যিনি আমাদের জীবনের কোনো না কোনো পর্বে তাঁর উপস্থিতি নিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে থাকেন। যদিও আমাদের আধুনিক বাংলা কবিতায় একমাত্র এই শর্তের কবি— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি আমাদের জন্মের আগে, জন্মের পরে, শৈশব, কৈশোর, যৌবন,বার্ধক্য, মৃত্যু ও মৃত্যুর পরেও কোনো না কোনোভাবে তা সে সুখে-দুঃখে, আনন্দ-ঘৃণা, শোকে-বিরহে যে কোনো মানবিক অনুভূতিতে তিনি আছেন এবং চিরকাল থাকবেন। পাঠকের মন ভালো করে দেওয়ার মতো হুমায়ুন আজাদের সেই রকম একটি কবিতা, বাচিক শিল্পী ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবৃত্তিতে মনের মধ্যে অনেকদিন এই কবিতার ছোঁয়া লেগে থাকে—
“ ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান,ভাটিয়ালি গান,ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো।
ভালো থেকো চর,ছোট কুঁড়ে ঘর ভালো থেকো।
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা নিশির শিশির।
ভালো থেকো জল,নদীটির তীর।”১৬
এই কবিতার মধ্যে আমাদের প্রকৃতিকে মানবিক-স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর করা হয়েছে। আমরা প্রকৃতির অঙ্গনে প্রকৃতির সঙ্গে আমৃত্যু আছি, থাকছি, অথচ, এই প্রকৃতিকে নিজের পরিবারের একজন সদস্য ভাবতে পারি না! নিশ্চয়ই পারি। প্রকৃতি আমাদের তার ফল, ফুল, খাদ্যবস্তু—সব উপাদান দিয়ে আমাদের জীবজগতকে প্রাণবান করে রেখেছে। সে যদি আমাদের কাছ থেকে ভালোবাসা অন্তত শুভেচ্ছা না পায়, তাহলে তো সেটা আমাদের দিক থেকে একধরনের গদ্দারি। প্রাণবানপ্রকৃতি এটা কিন্তু মানুষের কাছে অন্তত তার ভোক্তাদের কাছ থেকে এই সামান্য ধন্যবাদটুকু আশা করে। হুমায়ুন আজাদ তাঁর এইধরনের কবিতায় প্রকৃতিকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে ফারাক এনে দিয়েছেন। প্রকৃতির গাছ-পালা, খাল-বিল, মেঘ-তারা সব যেন আমাদের পরিবারের সদস্য। নিসর্গ-প্রকৃতিকে নিজের পরিবারের একজন সদস্যের মতো শুভেচ্ছাজ্ঞাপন করা,তাকে কুশল বার্তা দেওয়া, তার খোঁজ নেওয়া প্রকৃতির আরো কাছে পৌঁছানোর প্রয়োজনীয়তা আমরা এখন হাড়ে হাড়ে অনুভব করছি। আধুনিক সভ্যতার নামে আমরা যতই অরণ্য কেটে, সবুজ ধ্বংস করে ইট-কাঠ-লোহা-লক্কর-সিমেন্ট দিয়ে পৃথিবী মুড়ে দিয়ে, আসলে কিন্তু আমরা প্রকৃতির কাছ থেকে ‘ দিন বা দিন’ দূরে সরে যাচ্ছি। আর যত দূরে যাচ্ছি প্রকৃতিকে আরো বেশি প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছি। হুমায়ুন আজাদের কবিতায় কিন্তু আমাদের মানব প্রজাতির জন্য এই চেতাবগ্নি বহাল থাকছে। আমাদের বাংলা কবিতায় প্রকৃতিকে নিয়ে বেশিরভাগ কবিই কবিতা লিখেছেন। যে কোনো সাহিত্যকারদের রচনায় প্রকৃতি থাকবে না তা হয় না, সার্থকতার বিচারে পল্লিকবি বিশেষণে জসীমউদ্দীন সর্বাধিক পরিচিত হলেও আল মাহমুদও কম যান না। অবশ্য প্রত্যেকের লেখার ঘরানা-চিন্তনের প্রক্রিয়া, লেখার স্টাইল আলাদা। সেই নিরিখে হুমায়ুন আজাদের কবিতায় প্রকৃতি যেন মানুষের সাথে মনের কথা বলে। মানুষ আর নিসর্গপ্রকৃতি একে-অপরের স্নেহ-সৌহার্দ্যে, হার্দিক উষ্ণতায় পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলে।
হুমায়ুন আজাদের শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘পেরোনোর কিছু নেই’, (২০০৪) অবশ্যই এটি হুমায়ুন আজাদের সবচেয়ে বেশি পরিণত, ছন্দ ও বিষয়-ভাবনার বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল। কবিতায় অন্ত্যমিলের ব্যাপারে এই পর্বে কবিকে বিশেষ প্রযত্ন নিতে দেখা যায়। এই গ্রন্থের ভূমিকারস্থলে যা লেখা হয়েছিল তা অবিকল রাখছি, কারণ তাতে উদ্দেশ্যটি বোঝা যাবে—“বাংলা কবিতা যখন দূষিত, ক্লেদাক্ত হয়ে উঠেছে রাজনীতি, শ্লোগান, বানোয়াট পাগলামো, বিকার, প্রতিক্রিয়াশীলতা,অশুদ্ধ গদ্য ও অকবিতার অসুস্থ আক্রমণে, তথাকথিত কবিতা হয়েছে ছোটোবড়ো তুচ্ছ জীর্ণ পংক্তির সমষ্টি, যখন বাংলা ভাষাই হয়ে উঠেছে দূষিত তখন হুমায়ুন আজাদের পেরোনোর কিছু নেই ফিরিয়ে এনেছে প্রকৃত কবিতাকে; কবিতাকে আবার কবিতা করে তুলেছে। তিনি ফিরিয়ে এনেছেন ছন্দ, মিল, যা হারিয়ে গিয়েছিল কবিতা থেকে,এবং প্রকাশ করেছেন প্রাজ্ঞ উপলব্ধি, স্মৃতিকাতর প্রশান্তি, ও তীব্র প্রেমের আবেগ ও সৌন্দর্য।...”১৭
এই কাব্যগ্রন্থের নাম-কবিতায় কবি সব কিছু পেরোনোর কাজ সমাধা করেছেন বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছেন। এখন আর পেরোনোর মতো কোনো কিছু আর নেই! হুমায়ুন আজাদ কী অন্তর্যামী ছিলেন! ছিলেন বোধহয় – নাহলে কী করে এরকম কথা বলবেন—
“মরুভূমি;- পার হ’তে হবে; আগুনই সত্য, ঢুকেছি আগুনে।
ছিটকে পড়েছি, মাথা গুঁজে প'ড়ে থেকেছি দুপুরে মরুভূমি
জুড়ে, স্বপ্নে দেখেছি সবুজ, চোখের সামনে বয়ে গেছে মায়ানদী,
জলের তৃষ্ণায় কঙ্কাল জড়িয়ে ধ’রে প'ড়ে থেকেছি বালুতে।
এক সময় দেখতে পেয়েছি পার হয়ে গেছি মরুভূমি।
আজ পেরোনোর কিছু নেই, ব’সে আছি-স্তব্ধ, শুনি শূন্য বাতাসের
শব্দ, দেখি অন্ধকার নেমে আসে মাঠেজলে শস্যে শব্জিতে।” ১৮
এই মুক্তমনা কবি-পুরুষটি অচিরেই মৌলবাদিদের নজরে পড়ে গেলেন। বিশেষ করে তাঁর ‘নারী’ (১৯৯২)উপন্যাসটি প্রকাশের পর তিনি মৌলবাদীদের কুনজরে পড়ে যান। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির গ্রন্থমেলা থেকে বাড়িতে ফেরার পথে মুখঢাকা সন্ত্রাসীর চপারের আঘাত খেতে হয়। সরকারী হাসপাতালে যমে-মানুষে টানাটানিতে সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান, কিন্তু সেই বছরেই আগস্ট মাসে জার্মানির মিউনিখে নিজের ফ্লাটে রহস্যজনকভাবে কবিকে মৃত অবস্থায় আবিস্কার করা হয়। মৌলবাদী তথা সন্ত্রাসবাদিদের নেটওয়ার্ক কত স্ট্রং,তাদের টারগেটেড বা লক্ষ্যবস্তু একবার ‘লকড’ হয়ে গেলে সেখান থেকে কারোরই মুক্তি নেই। হুমায়ুন আজাদও ছাড় পান নি। এ বড়ো বেদনার। যে হুমায়ুন আজাদ নিজের দেশে একটি মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই দেশেই তাঁকে মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়। তিনি একসময় নির্ভয়ে বলেছিলেন যে- “এই দেশ কোনো অন্ধ মৌলবাদীর হাতে নিহত হওয়ার জন্য নয়।” অথচ কী ট্রাজেডি, আমাদের এই কবিকেই সেই মৌলবাদিদের হাতেই অকালে, বাংলা সাহিত্যকে অধূরা রেখে চলে যেতে হলো। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে নিউ ইয়র্কে ‘মুক্তধারা’ আয়োজিত নিউইয়র্ক বইমেলার তিনি উদ্বোধক হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন। সেই বইমেলায় আলাপচারিতায় সাহিত্যকর্মী ফকির ইলিয়াস কবিকে কথার প্রসঙ্গক্রমে জিজ্ঞেস করেছিলেন—‘আপনাকে কবিতা লিখতে হলো কেন? এবং আপনি কেন অন্যদের সময়ে বেঁচে আছেন?' এই দুটো প্রশ্নের প্রথমটির উত্তরে তিনি নিষ্পাপ, নিরাভরণ জবাব দিয়েছিলেন—“আমি আমার পক্ষীকুলকে ভালোবাসি বলে। আমি আমার নদীগুলোকে ভালোবাসি বলে।”১৯
আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন—‘এর উত্তর আরো বিশ বছর পর জানতে পারবে।' দুঃখের বিষয় সাংবাদিককে সেই উত্তরের জন্য বিশ বছর অপেক্ষা করতে হয় নি। তার অনেক আগেই জঙ্গি খুনিরা তার ওপর হামলে পড়েছিল। দ্বিধা নেই হুমায়ুন আজাদের সৃজিত অক্ষরেরা বেঁচে আছে, তাঁর নদী-গাছপালা বেঁচে আছে, তাঁর মনন সাহস চন্দ্ররেখা বেঁচে আছে, তারাই তার হয়ে কথা বলবে, তাঁর অপূর্ণতা একদিন পূর্ণতা পাবে। গতানুগতিক কবিবৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন আজাদ আধুনিক বাংলা কবিতায় যে নতুন প্রস্রবণ আনলেন সেই নিঃসন্দ্য বাঙালি পাঠক শতাব্দীর পর শতাব্দী নিরবধি পান করে যাবেন।
সূত্র নির্দেশ :
- শঙ্খ ঘোষ, ‘বাবরের প্রার্থনা’, দে'জ পাবলিশিং, ১৩, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০৭৩, ৩১তম মুদ্রণ ২০১৭, পৃ-২৫
- Prof. Nicholas birns, "Vigilant Skepticism: The Poetry of Humayun Azad', Reviewed on Book of, "Humayun Azad Selected Poems', "Bivas', Ist Edition, February, 2014, translated by: Hassanal Abdullah, Dhaka, 2013
- ফারুক মাহমুদ, ‘আমাদের হুমায়ুন আজাদ’, ‘ভোরের কাগজ’, এপ্রিল ২৭, ২০১৯, (www.bhorerkagoj.com)
- সুকান্ত পার্থিব, ‘কবিতায় বহুমাত্রিক হুমায়ুন আজাদ’, ‘দ্য ডেইলি স্টার’, ৭০তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি, ২৮ এপ্রিল, ২০১৭ (www.thedailystar.net/bangla)
- হুমায়ুন আজাদ, ‘বন্ধুরা, আপনারা কি জানেন আপনারা শোষণ উৎপাদন করছেন?’, ‘হুমায়ুন আজাদ কাব্যসংগ্রহ’, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা- ১৮১
- ‘হুমায়ুন আজাদের কবিতায় প্রকৃতি’, দৈনিক পূর্বকোণ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি পাতা, (dainikpurbokone.net/literature-and-culture)
- ‘হুমায়ুন আজাদ, ‘একাকী কোরাস’, ‘হুমায়ুন আজাদ কাব্যসংগ্রহ’, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা- ৯৮
- হুমায়ুন আজাদ, ‘আমার চোখের সামনে’, ‘হুমায়ুন আজাদ কাব্যসংগ্রহ’, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা- ১৫৮
- হুমায়ুন আজাদ, ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’, ‘হুমায়ুন আজাদ কাব্যসংগ্রহ’, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা- ১১০
- অমিয় চক্রবর্তী, ‘বড়বাবুর কাছে নিবেদন’, বুদ্ধদেব বসু (সম্পাদিত) ‘আধুনিক বাংলা কবিতা সংকলন’, প্রথম সংস্করণ: মার্চ ১৯৫৪, এম সি সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৪, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০১২, পৃষ্ঠা- ১০৭
- হুমায়ুন আজাদ, ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’, ‘হুমায়ুন আজাদ কাব্যসংগ্রহ’, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।
- তদেব, পৃষ্ঠা-১৭৪
- হুমায়ুন আজাদ, ‘যা কিছু আমি ভালোবাসি’, ‘হুমায়ুন আজাদ কাব্যসংগ্রহ’, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা- ১৬৩
- মোহাম্মদ আজম, ‘হুমায়ুন আজাদ কোন অর্থে কতটা প্রথাবিরোধী?’ (www.academia.edu)
- তদেব, www.academia.edu
- হুমায়ুন আজাদ, ‘শুভেচ্ছা’, ‘হুমায়ুন আজাদ কাব্যসংগ্রহ’, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা- ২৪১
- হুমায়ুন আজাদ, ‘পেরোনোর কিছু নেই’, ‘হুমায়ুন আজাদ কাব্যসংগ্রহ’, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।
- হুমায়ুন আজাদ, ‘পেরোনোর কিছু নেই’, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ: ২০০৪, পৃ-১১
- ফকির ইলিয়াস, ‘হুমায়ুন আজাদের কবিতায় সাহসের চন্দ্ররেখা’, ৩০জুলাই ২০১৮, প্রতিদিনের সংবাদ, (http://protidinersangbad.com/archive)
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বিভাগীয় প্রধান, মানভুম মহাবিদ্যালয়, মানবাজার, পুরুলিয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
1 মন্তব্যসমূহ
অসাধারণ, পড়ে অবিভূত হলাম
উত্তরমুছুনপ্রাসঙ্গিক ও মার্জিত মন্তব্য করুন