স্মৃতি ভেসে গেলে

▇  শামসুল কিবরিয়া


তার বিষণ্ন চোখ দুটি কখনো শূন্যে ঝুলে থাকে কখনোবা এদিক ওদিক ঘোরাফিরা করে রাস্তা দিয়ে চলমান বা স্থির দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, ঘরবাড়ি, দোকানপাট বা গাড়ি দেখে। তার চোখ শুধু দেখেই যায়, কিন্তু মনের ভেতরে কোন অনুভূতি জাগায় না। এই অনুভূতিহীনতা তার সাথে লেগে থাকে দিনে, রাতে- সর্বক্ষণ। ঘরের ভেতরে, এমনকি বাইরেও, পাড়ার মোড়ের দোকানগুলোর সামনে রাখা বেঞ্চে ময়লা শরীরে ময়লা কাপড় পড়ে যখন মহিলাটি বসে থাকে বহির্বাস্তবের সাথে সংযোগহীন হয়ে, তখনো তার আশেপাশে ভিড় করে থাকে ঘন শূন্যতা। কোন একদিন তার অজান্তেই হয়তো এই বোধ তৈরি হয়েছিল। দিনে দিনে তা কেবল গাঢ় হয়েছে। তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে নিভৃত এক জগতে নিয়ে এসেছে। আর এই বর্তমান, ঘটনাবহুল জগৎসংসার তাকে কোনভাবে আলোড়িত না করে, একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছে। সময়ের থেকে ছিন্ন হতে হতে, প্রান্তে সরে আসতে আসতে শুধু কাপড় বা দেহই বর্ণহীন হয়নি, তার অন্তর্জগতের রং ও মুছে গেছে। অথবা অন্তর্জগতের নির্লিপ্ততাই তার বাহিরের দিকটাকে করেছে মলিন।

পাড়ার মোড়ে এভাবে ভাবলেশহীন বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা, কারো সাথে কথা না বলা, কখনো কথা বললে তাতে অসংগতি এবং পৌনঃপোনিকতার প্রাচুর্য- ইত্যাদি কারণে তার সাথে ‘পাগলি’ লেবেলটি সেঁটে গেছে। তবে কখনো কখনো পরিচিতজনদের সাথে এমনভাবে কথা বলে যে মনে হবে না তার মাঝে কোন ধরণের অস্বভাবিকতা রয়েছে। তবু দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততার ফলে মানুষ অস্বাভাবিক আচরণের যে কারো ক্ষেত্রে যেভাবে পাগল/ পাগলি শব্দটি খুব সহজেই ব্যবহার করে তার  ক্ষেত্রেও এভাবেই এ শব্দের প্রয়োগ ঘটায়।

নিজেকে আড়ালে নিয়ে যাওয়া আবার সে আড়াল ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসা-এই যুগপৎ আচরণে তার আবদ্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তাকে তার কাছে ধরা না পড়লেও অন্যদের কাছে তা মোটেও কোন অস্পষ্ট ব্যাপার নয়। নিজস্ব জগতে তার একাকি পরিভ্রমণ অবিরত চলতে থাকে। এই জগতে কোন পরিবর্তন আসে না। ঘরের ভিতরে, পাড়ার মোড়ে বা রাস্তায় তার দিনগুলো কাটে। পাড়ার পরিচিত বা অপরিচিত কারো কৌতূহল বা মাথাব্যথা নেই তার জন্য। নিজেদের নানাবিধ সমস্যা, জীবনযাপনের জটিলতা তাদেরকে এমনিতেই ব্যস্ত রাখে সর্বদা, তার উপর এই ‘পাগলি’ মহিলাকে নিয়ে ভাবার সুযোগ কোথায়, যৌক্তিকতাই বা কী?

এ এলাকায় বেশ কিছুদিনের বসবাসের কারণে আমারও কথা হয়েছে এ মহিলার সাথে। বেশিরভাগ সময়েই অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক কথা। সে-ই আমাকে একদিন হঠাৎ করে ডেকে জিজ্ঞেস করে কোন বাসায় থাকি, কি করি ইত্যাদি। যেহেতু তার সম্পর্কে আমার ধারণা আছে তাই থতোমত খাই না বরং তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি। তার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পর আরো কিছু কথা বলে যেগুলোর কোন আগামাথা ছিলো না। শেষে টাকা খোঁজলে দশ টাকার একটি নোট হাতে দিয়ে আমার পা চালিয়ে দেই সামনে, আমার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

কয়েকবার তার সাথে কথা বলার কারণে বা হয়তো এমনিতেই সে আমার ভাবনার ফাঁকে এসে ঢুকে পড়ে। আমার জানতে ইচ্ছা করে এই যে ভাবলেশহীন হয়ে সে বসে থাকে বা চলাফেরা করে সেসময় কি তার মনে ফেলে আসা দিনের কোন সুখের স্মৃতি বা দুঃখ ভারাক্রান্ত কোন ঘটনা ভেসে উঠে বা অনাগত দিন নিয়ে কোন শংকাবোধ তাকে আক্রান্ত করে? আমার এ কৌতূহল মেটে না কেননা এসব নিয়ে তার সাথে কথা বললেও সে হয়তো  কিছু বুঝিয়ে বলতে পারবে  না। তার ভেতরের কথা তো অন্য কেউও বলতে পারবে না। আবার এই বলে নিজেকে বুঝিয়ে দেই যে তার মধ্যে হয়তো এসবের কিছুই এসে উঁকি দেয় না। তার বাহ্যিক আচরণ তো এ ধারণাই দেয়। তাই পুনরায় জাগার সম্ভাবনা  রেখে কৌতূহল স্তিমিত করে দিয়ে আমি আমার জগতে ডুবে যাই। আর বেশিরভাগ সময়েই তো তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। যেমন চলে যায় এ পাড়ার অন্যান্য বাসিন্দা, চায়ের দোকানে চা খেতে আসা লোকজন, দোকানের ক্রেতা, পার্শ্ববর্তী ট্রাভেল এজেন্সির গ্রাহক, ক্লিনিকের রোগীর অ্যাটেন্ডেন্ট এবং ডাক্তারের কাছে আসা  মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ।

এ পাড়াটা যখন এতটা শহুরে বৈশিষ্ট্য লাভ করেনি তখন থেকেই এ মহিলা এখানে বসবাস করছে। দীর্ঘ বসবাসের কারণে তার পরিচিত মহল একবারে কম নয়। তখন জনবসতি কম থাকায়  একে অপরের সাথে পরিচিত হয়ে যেত খুব সহজেই। আর নাগরিক জটিলতা প্রকটভাবে আচ্ছন্ন না করার কারণে মানুষের মধ্যে  নৈকট্যের বোধ বিরাজ করত। এখনকার ঘন সন্নিবিষ্ট বাসা-বাড়ি, ক্রমবর্ধমান জন ঘনত্ব পূর্বের পারস্পরিক আন্তরিক পরিচিতির ব্যাপারটি  হয়তো বুঝতে দিবে না । কিন্তু সে সময়ে এ ব্যাপারটি ছিল খুবই স্বাভাবিক। এই মহিলার মনে সেসব দিনের কথা  ভেসে উঠে কি? আর আসলেও তাকে কোনভাবে আলোড়িত করে কি? নাকি একেবারেই আসে না? আর যদি আসে বা হয়তো অতীত আর বর্তমানের সাথে প্যাঁচ খেয়ে তাকে বিভ্রান্ত করে ফেলে অথবা ভেসে উঠেই টুপ করে অতলে ডুবে যায়।

মহিলা এবং এ পাড়া সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাপার আমি শুনি এখানকার একজন  একজন প্রবীণ বাসিন্দার কাছ থেকে। একদিন চায়ের দোকানে তার পাশে বসে চা খেতে খেতে আলাপ জমে  ওঠে। কথায় কথায় হঠাৎ মহিলার প্রসঙ্গ আসলে তিনি আমাকে  এ বিষয়গুলো বলেন।

এ মহিলার স্বামী গ্রাম থেকে এখানে এসে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা শুরু করে। কোন নির্দিষ্ট পণ্য নয়, যখন যা সুবিধা হত তাই  বিক্রি করত। এ পেশাতেই সে আমৃত্যু জড়িত ছিল। এ পাড়ায় এসে যখন  সে বসবাস শুরু করে তখনো বিয়ে করেনি। শহরে এসে কিছুদিন ব্যবসা করে গ্রামে গিয়ে বিয়ে করে। বিয়ের বছরখানেক পর স্ত্রীকে এখানে নিয়ে আসে। তাদের  একমাত্র সন্তান সানোয়ার- বাবা মারা যাওয়ার পর যে আর কিছু না করে বাবার ভ্রাম্যমাণ ব্যবসাই চালিয়ে নিচ্ছে- তার জন্ম এখানেই। তার জন্মের পর, আগে যে যা-ই ডাকুক, তার পরিচিতি ঘটে ‘সানোয়ারের মা’ হিসাবে। এখনো- সে মানুষের মনোযোগের বাইরে থাকলেও-পাড়ার পুরনো বাসিন্দারা তাকে ‘সানোয়ারের মা’ বলেই ডাকে। আর সানোয়ার, জন্মের পর এখানেই যে শৈশব, কৈশোর কাটিয়ে যৌবনে প্রবেশ করেছে, বাপ মারা যাওয়ার আগে বলতে গেলে উড়নচণ্ডীই ছিল। পড়াশোনা তো করেইনি বরং এমন কিছু বন্ধুবান্ধব জুটিয়েছিল যারা তারই মতো একই পথের পথিক। যেহেতু পড়ালেখা করেনি তাই তার বাবা অনেক চেষ্টা করেছে কোন একটা কাজে লাগিয়ে দিতে। কিন্তু সে এসব পাত্তা দিতে চায়নি। এ সানোয়ারই বাবার মৃত্যুর  পর এভাবে বদলে যাবে কেউ হয়তো তা ভাবতেও পারেনি।

অবশ্য বাহিরের দিকটা সামাল দিলেও ঘরের ভেতরে সানোয়ার নজর দেয়নি। হয়তো সে মনে করেনি যে এদিকে নজর দেয়ার প্রয়োজন আছে। মা তো আছেই। মা রান্না করে, কাপড় ধোয়, পরিচিত প্রতিবেশী কারো সাথে গল্প করতে করতে পান খায়। তার সমস্ত ব্যস্ততা ঘরের বাহিরে– ব্যবসায়, বন্ধুদের আড্ডায় কিংবা অন্য কোন কাজে। ঘরের ভেতরে এসে মায়ের সাথে একটা দুটো কথা বলে, খাবার খায় আর মোবাইল চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়ে। এই দৈনন্দিনতার ভেতরেই মা যে অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে তার মা নিজে যেমন  বুঝতে পারেনি, বুঝতে পারেনি সানোয়ারও। যখন সে খেয়াল করে ততদিনে মায়ের আচরণে অনেক অস্বাভাবিকতা  এসে গেছে। ঘরের বিভিন্ন কাজে অসুবিধা শুরু হলে সানোয়ার  মাকে নিয়ে সত্যিই চিন্তায় পড়ে যায়। এই অবস্থায় কি করা যায় বা আদৌ কিছু করা যায় কিনা তা ভাবতে ভাবতে আরো কিছু দিন চলে যায়।

অবশেষে সানোয়ার মাকে ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করে। এতদিন কেন ডাক্তারের কাছে যায়নি এ নিয়ে অনুশোচনায় ভোগে। যদি প্রথম থেকেই সমস্যাটি ধরতে পারত আর ডাক্তারের পরামর্শ নিত তাহলে হয়তো মা ভালো হয়ে যেত। এরকম অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হয়ে মন ভারাক্রান্ত হতো না।

মাকে কোন ডাক্তার দেখাবে? পাগলের ডাক্তার ? মা কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? অন্য কেউ এরকম করলে তো সে পাগলই বলতো। কিন্তু নিজের মাকে পাগল ভাবতে পারে না। আর মা উল্টাপাল্টা কাজ করলেও এখনোতো কিছু কাজ ঠিকঠাক করতে পারে। তবে এখন আর বিকল্প কিছু ভাবার সুযোগ নেই বলে মার সাথে আলাপ করে এ বিষয়ে:
– আম্মা, তুমারে লইয়্যা  ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগব।
– আমার তো কোন অসুখ নাই।
– অসুখ আছে, তুমি বুঝতাছ না।
এরপর মা কিছু কথা বলে যার সাথে মূল বিষয়ের কোন সংগতি নেই। তার কথা না থামা পর্যন্ত সানোয়ার অপেক্ষা করে। কথা থেমে গেলে সে বলে,
– আম্মা, ডাক্তারের কাছে যাইমু।
– আবার ডাক্তারের কথা কছ। কইছি না আমার কোন অসুখ নাই। যা ইখান থাইক্যা। আমি এখন পান খাইমু।
– কালকেই তুমারে লইয়্যা যাইমু।
– আমার অসুখ থাকলে আমি বুঝমু না তুই বুঝবি?
– অনেক সময় নিজেরটা নিজে বুঝা যায় না।

এভাবে মায়ের সাথে কয়েকবার কথা হয় কিন্তু তাকে রাজি করাতে পারে না। বাবা বেঁচে থাকতে একবার তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়েছিল। তখনো তার অনীহা ছিল। তবু বাবার জোরাজুরিতে যেতে হয়েছিল। এরপর অবশ্য তাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া লাগেনি। ছোটখাটো রোগের জন্য ফার্মেসিতে জিজ্ঞেস করে ঔষধ এনে খাইয়ে দিলেই সেরে গেছে। কিন্তু এখনকার অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া যখন অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন মায়ের অনীহাকে গুরুত্ব না দিয়ে, তার বন্ধু ইলেকট্রিক মিস্ত্রি জহিরের সাথে আলাপ করে পরের দিনই মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়।

ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ফার্মেসিতে নিয়ে গেলে সে জানতে পারে ঔষধগুলো অনেক দামী। আর এগুলো বন্ধ রাখা যাবে না। নিয়মিত খেয়ে যেতে হবে। এক সপ্তাহের ঔষধের দাম যা হয় তার হাতে থাকা টাকা দিয়ে তা কোনরকম কেনা হয়ে গেলে, পরে কি হবে তা আর না ভেবে  ঘরে ফিরে আসে।

মায়ের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সানোয়ার আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এত দামি ঔষধ কেনা তার পক্ষে অসম্ভবই বলতে গেলে। ব্যবসা থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে থাকা খাওয়া ও অন্যান্য টুকটাক খরচ চলে যায় কোনমতে। কোন সময়ে অতিরিক্ত খরচ হয়ে গেলে এর রেশ থেকে যায় অনেক দিন। মানুষের কাছে পণ্য বিক্রি করা তো এত সহজ কাজ নয়। কারো যদি প্রয়োজন হয় বা তার কাছে থাকা পণ্যটি পছন্দ হয় তাহলে কিনবে নইলে দেখে নাড়াচাড়া করে চলে যাবে। সে জোর করে কত আর বিক্রি করতে পারবে। হাতের টাকাগুলো চলে যায় ঔষধ কিনতেই। ডাক্তারের দেয়া পরীক্ষাগুলো এখন করাবে কিভাবে? ডাক্তার বলেছে এগুলো অবশ্যই করাতে হবে। তাই সে টাকার জন্য দমে না গিয়ে পরিচিতদের কাছ থেকে ধার করে এ পরীক্ষাগুলো করায়। পরীক্ষার ফলাফল দেখে ডাক্তার আগে যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তা আরো দৃঢ়ভাবে বলেন যে এ রোগ আসলে ভালো হবে না। ব্রেইনের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যাবে। ঔষধ এই কমার হার কমাতে পারে কিন্তু পুরো ভালো করতে পারবে না।

ইচ্ছা থাকলেও সানোয়ার নিয়মিত ঔষধ কিনতে পারে না। যে দেনাগুলো ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে তা-ই এখনো পুরো শোধ করতে পারেনি। তাই মাঝে মাঝে ভাবে যেহেতু ঔষধ খেলেও এ রোগ সারবে না তাহলে খাওয়ার দরকারই বা কি? ডাক্তারের ভাষ্যমতে যা যা ঘটার কথা, মাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করার কারণে সে দেখছে যে, তার কিছু কিছু তার মধ্যে ঘটে চলেছে। অবশ্য পরিবর্তনগুলো এখন এত দৃশ্যমান যে এমনিতেই তা বুঝা যেত। তার জন্য বাড়তি প্রচেষ্টার দরকার পড়ত না।

আরো কিছুদিন কেটে গেলে অনিয়মিতভাবেও ঔষধ চালিয়ে নেয়া তার জন্য অনেক কঠিন হয়ে যায়। এর ভেতরে মাকে নিয়ে আরো দুবার ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি ঔষধ চালিয়ে নেয়া ছাড়া আর কোন চিকিৎসার কথা বলেন না। শেষবার দেখানোর সময় আরো দুইমাস পর আসার কথা বললেও সে আর যায়নি।

মায়ের অবস্থার ক্রমঅবনমন তাকে আরো মন খারাপের দিকে ঠেলে দেয়। অবশ্য তার আচরণে কখনো বেশি বিরক্ত হয়ে গেলে দুকথা শুনাতেও ছাড়ে না। সানোয়ারকে এখন বাইরের দিক দেখার পাশাপাশি ঘরের কাজ এমনকি রান্নাবান্নাও করতে হয়। তাই মেজাজ খিটখিটে হতে সময় লাগে না। আর এভাবে দিন কাটাতে কাটাতে তার কাছে সবকিছু পানসে হয়ে আসতে থাকে।

....................
আজ এমন ঘটনাই ঘটে গেছে যা সানোয়ার বা তার ঘনিষ্ঠজন বা প্রতিবেশী কারো মাথায় কোনদিন আসেনি যে সানোয়ারের মা একদিন হঠাৎ করে হারিয়ে যাবে। অফিস থেকে ফেরার পথে এ সংবাদ শুনে আমিও স্তম্ভিত হয়ে যাই। কেন আর কিভাবেই বা সে হারিয়ে যাবে তা আমি বুঝতে পারি না। আমার কৌতূহল বাড়তে থাকে। তাই বাসায় না গিয়ে কখনো মানুষের জটলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি, কখনোবা চায়ের দোকানে বসে কারো সাথে কথা বলি সানোয়ারের মায়ের হারিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে।

প্রতিদিনের মতোই আজও সানোয়ার তার মাকে ঘরে রেখে কাজে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় মায়ের সাথে কোনদিন দুএকটা কথা বলে যায়, কোনদিন আবার কোন কথাই বলে না। খাওয়া-দাওয়া সেরে  চুপ করে বেরিয়ে যায়। মা-ও এসব ব্যাপারে নির্বিকার। ছেলের আসা যাওয়া, কথা বলা, না বলা তাকে হয়তো কোনভাবে স্পর্শ করে না। বা করলেও তাকে আলোড়িত করে না। বাইরে গিয়ে মায়ের দাঁড়িয়ে থাকা, এর সাথে ওর সাথে উল্টাপাল্টা কথা বলা- আগে সানোয়ারকে বিব্রত করলেও এখন সে এসবের সাথে মানিয়ে নিয়েছে। নিয়ন্ত্রণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে বিফল হলে সে তাকে তার মতো করে ছেড়ে দিয়েছে। সে কাজে চলে গেলে মায়ের কি হবে তা নিয়ে আর এতবেশি ভাবে না। মায়ের এসব আচরণ তাকে বরং এখন মাঝে মাঝে রাগান্বিত করে। গতকালও নাকি কোন এক বিষয়ে অনেক রাগারাগি করেছে। বাইরে কোন কারণে কারো সাথে ঝগড়া হয়েছে। আর এটার জের গিয়ে পড়েছে মায়ের উপর। তবে মা কিন্তু নিরুত্তরই থেকে গেছে। ছেলের কোন কথাতেই প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সকালে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সানোয়ার দেখে যায় তার মা জানালার বাইরে উদাস দৃষ্টি মেলে রেখেছে।

ঘরে ফিরে দরজা খোলা পেলে সাধারণত মাকে সে ডাকে। বাইরে চলে গেল কিনা মূলত তা জানার জন্য। কিন্তু আজ কয়েকবার ডেকেও সাড়া না পেলে ঘরের বাইরে  আশেপাশে  খোঁজে। কোথাও তাকে পায় না। প্রথমে কাউকে কিছু না বললেও পরে আশেপাশের পরিচিতজনদের জিজ্ঞেস করে তার মাকে কেউ দেখেছে কিনা। কেউ বলে কোন এক সময় রাস্তায় দাাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে, কেউ আবার বলে আজ তাকে দেখেইনি। ফলে সানোয়ারের উদ্বিগ্নতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। কয়েকজনের জনের সাথে মায়ের ব্যাপারে কথা বলাতে এ সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে যায় যে, সানোয়ারের মাকে  খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ সংবাদ মানুষের মাঝে ঔৎসুক্য সৃষ্টি করে যার কারণে পাড়ার মোড়ে তারা আস্তে আস্তে ভিড় জমাতে শুরু করে।

মা কোথায় যেতে পারে এ ব্যাপারে সানোয়ার কোন ধারণাই করতে পারে না। দীর্ঘদিন ধরে শহরে থাকলেও তাদের এত আপনজন কেউ নেই যে  মা তাদের কারো কাছে চলে যাবে। তাহলে কি গ্রামে চলে গেল? সানোয়ারের ভাবনায় এ বিষয়টিও আনোগোনা করে। কিন্তু পরে নিজেই আবার বাতিল করে দেয়, না এ হতেই পারে না। মা কোনভাবেই সেখানে একা যেতে পারবে না। আর গ্রামে যাবেই বা কার কাছে? গ্রামে স্বজন যারা আছে তাদের সাথে তো দীর্ঘদিনের বিচ্ছিন্নতা ঘটে গেছে। বাবা বেঁচে থাকতে তিনি অল্প হলেও যোগাযোগ রাখতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর কারো পক্ষ থেকেই যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন দেখা দেয়নি। আর গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছা করলেও যে মা একা যেতে পারবে এমন কোন সম্ভাবনাই নাই। কেননা মা তো অনেক দিন ধরে একা কোথাও যায়নি। কোন কারণে কোথাও যেতে চাইলে বাবা বেঁচে থাকতে বাবাকে বা তাকে নিয়ে আর বাবা মারা গেলে তাকে  সাথে নিয়ে যেত। এই যাওয়ার পরিমাণ খুবই কম। তাই বলতে গেলে এ পাড়ার ভেতরেই জীবনের সিংহভাগ কাটিয়ে দিয়েছে। এজন্য শহরের ভেতরে থাকলেও এ শহরের বেশিরভাগ জায়গাই তার কাছে অপরিচিত। মার যাওয়ার ব্যাপারে বিকল্প অনেককিছু ভেবেও তাই কোন কূল পায় না সানোয়ার।

সানোয়ারকে ঘিরে থাকা মানুষেরা নানা ধরণের পরামর্শ দিলেও সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না এখন কি করবে? ব্যবসা-বাণিজ্য, খাওয়া দাওয়া তো মাথা থেকে চলে গেছে অনেক আগেই। তার সমস্ত মনোযোগ মাকে ফিরে পাওয়ার উপায় খোঁজায় কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। কোন সিদ্ধান্ত না নিতে পারায় সে অসহায় বোধ করে। তার এ অবস্থা বুঝতে পারে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি হারুণ, যে দীর্ঘদিন ধরে তার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। সানোয়ারকে জটলার ভেতর থেকে বের করে এনে বলে- ‘ইখানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া শুধু পরামর্শ শুনলে তো অইতো না।’
– আমি বুঝতে পারতাছি না কি করতাম?
– আমার মনে হয় চাচী এই পাড়ার ভিতরে নাই। বাইরে কোন জায়গায় গেছে। দরকার অইলে মাইকিং করাতে অইব।

হারুণের মতো পরামর্শ ইতিমধ্যে অনেকেই দিয়েছে। কিন্তু একান্তে বলাতে সে এ বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়েছে। তাই হারুণকে বলে– ‘তুই তাড়াতাড়ি এ ব্যবস্থা কর আর আমি বাবুলরে লইয়্য থানায় যাই।’
কোন কাজে থানায় সানোয়ারের যাওয়ার দরকার না পড়লেও বিভিন্ন কারণে থানায় বাবুলের যাতায়াত আছে। তাই জিডি করার ব্যাপারে সে সহযোগিতা করতে পারে। সানোয়ার একা এলে হয়তো এ বিষয়টা বুঝে উঠতেই অনেক সময় নিত। বাবুলের পরিচিতির কারণেই হয়তো পুলিশ আশ্বাস দেয় তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে তার মাকে খোঁজে বের করতে। তবু সানোয়ার ভরসা করতে পারে না। কিন্তু এখন ভরসা না রেখেও কোন উপায় নাই।

থানা থেকে বেরুনোর সময় হারুণ জানিয়ে দিয়েছে যে সে মাইকিং এর ব্যবস্থা করে ফেলেছে। কিছুক্ষণের ভেতরেই মাইক নিয়ে রিকশা বেরিয়ে পড়বে হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রচার করতে। বিজ্ঞপ্তিতে কি কি বলতে তা হারুণকে বলে দিতে হয় না। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের কারণে তার সব কিছুই জানা আছে।

থানা থেকে ফেরার পথে বাবুল বলে– হাসপাতালেও তো খোঁজ নেওয়া দরকার। কোন দুর্ঘটনার কবলে পড়লে কেউ তো সেখানে নিয়েও যেতে পারে। বাবুলের এ কথায় সানোয়ার যেন আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। যদি দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে তাহলে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে কে জানে? বাবুলের কথায় হাসপাতালে যাওয়ার তাড়া অনুভব করলে দ্রুত একটি সিএনজি অটোরিকশা চড়ে শহরের সবচেয়ে বড় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। দুর্ঘটনায় কবলে কেউ পড়লে সেখানেই সাধারণনত নেয়া হয়। তারা এখান অনেক খোঁজ নেয় কিন্তু আজ এরকম কেউ হাসপাতালে আসেনি। এখান থেকে বেরিয়ে তাই তারা শহরের অন্য আরেকটি সরকারি হাসপাতালে যায়। কিন্তু সেখানেও পায়নি। এরপর সানোয়ার ও বাবুল পরামর্শ করে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের খোঁজ নেয়ার জন্য দুজন দুদিকে চলে যায়।

অনেক ঘোরাঘুরি করে কোন সংবাদ না পেয়ে তারা পাড়ায় ফিরে আসলে আগের জটলা বাঁধা মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও তাদের অনেকেই জিজ্ঞাসু চোখে আবার জড়ো হতে থাকে পাড়ার মোড়ে। কিছু নতুন মানুষও কৌতূহলী হয়ে এদিকে চলে আসে। সানোয়ারকে তারা নানা ধরণের প্রশ্ন করলেও সে কোন উত্তর দেয় না। মাকে না পেয়ে সে যেন একবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমি দেখলাম মাকে হারানোর তীব্র বেদনা তার চোখে মুখে গাঢ় হয়ে লেগে আছে। আমার মনে যেসব জিজ্ঞাসা জড়ো হয়েছিল তা আর প্রকাশ করতে হয়নি কেননা এগুলো আমি বলার আগেই কেউ না কেউ বলে ফেলেছে।

সানোয়ারের পক্ষ থেকে উত্তর দেয় বাবুল। আমার মনে হওয়া বা আমার মতো অনেকরই মনে হওয়া প্রশ্নগুলোর কোনটিরই ইতিবাচক কোন উত্তর আসে না। নতুন কিছু না পেয়ে জড়ো হওয়া মানুষ আবার নিজেদের কাজে বা আড্ডায় ফিরে যায়।আমিও বাসায় চলে আসি।

সানোয়ার কোথায় যাবে? তার কাছে এখন বাসায় বা পাড়ার মোড়ে বা অন্য কোথাও থাকা একই কথা। শারীরিক অবস্থানের পরিবর্তন ঘটলেও মানসিক অবস্থার তো পরিবর্তন হবে না।

সন্ধ্যা পার হয়ে রাত গভীর হয়। বাসায় কিছু সময় বসে সে আবার বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। একা একা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে বেশ সময় ধরে । কিন্তু সবদিক থেকেই ফিরে আসতে হয়েছে আশাহত হয়ে। মাইকিং এর কোন ফলাফলও পাওয়া যায়নি। বাবুলের মাধ্যমে থানায় যোগাযোগ করা হলে তারাও কোন সংবাদ জানাতে পারেনি। এসব কারণে সানোয়ারের শরীর মন একেবারে অবসন্ন হয়ে আসে।

পাড়ার পরিচিত যার সাথে দেখা হয় সে-ই সান্ত¦নার সুরে  কথা বলে। ধৈর্য্য ধরতে বলে। কিন্তু কত আর ধৈর্য্য ধরবে সে? মা যদি সুস্থ থাকত তাহলে না হয় অপেক্ষা করত। কোননা কোন সময় ফিরে আসবে। কিন্তু তার মানসিক যে অবস্থা তাতে করে এই ভরসা পাওয়া যায় না। তাহলে কি মাকে আর পাওয়া যাবে না? না, এটা তার ভাবনাতেই আসে না। মা-হীন একটি দিনও সে কল্পনা করতে পারে না। মাকে ফিরে পাওয়া চাই-ই চাই। কিন্তু কিভাবে? কিভাবে হারিয়ে যাওয়া মাকে  খোঁজে পাবে?

কাল রাতে মায়ের সাথ রাগ করে কথা বলার বিষয়টি তাকে বারবার বিদ্ধ করছে। মা কি এ কারেণই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল? তার উপর অভিমান করেছে?  মা তো কোনদিন তার এমন কথাবার্তায় কোন  প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সে যা-ই বলুক নির্বাক চেয়ে থেকে কেবল  শোনে গেছে। হয়তো ভালো করে বুঝতেও পারে নি যে ছেলে তার উপর রাগ করেছে অথবা এমনও হতে পারে ছেলর রাগরাগিকে সে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে। কিন্তু আজ করলো কেন? কোন ব্যাখ্যাই পায় না। মা হয়তো হাঁটা শুরু করে সামনের দিকে অজান্তেই এগিয়ে গেছে। কোথায় যাচ্ছে তা বুঝতেই পারেনি। ফিরে যে আসবে এ বোধও তার জাগেনি।

রাতটাকে অসম্ভব দীর্ঘ মনে হচ্ছে। সময় যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কোনভাবেই সামনে এগুতে চাচ্ছে না যেন। এমনিতে তো সারাদিনের  ক্লান্ত দেহটা বিছানায় লাগিয়ে দিলে রাত কিভাবে সকালের দিকে অগ্রসর হয় তা বুঝতে পারে না। কিন্তু আজ বিছানায় যেতেই ইচ্ছে করছে না বলে বসে বসে নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে। শারীরিক ক্লান্তি মানসিক অস্থিরতার কাছে হেরে যায়।

পাড়াজুড়ে বিস্তৃত হয়ে আছে ঘন নির্জনতা। স্ট্রিটলাইটের আলো জ্বলছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। যে দুএকজন তার সাথে শেষপর্যন্ত ছিল তারাও নিশ্চয় এতক্ষণে ঘুমের অতলে ডুবে গেছে। সানোয়ার টের পায় ভয় যেন তাকে ঘিরে ধরছে। কেননা মা-হীন এই ঘরে বিরাজ করছে কেবল শূন্যতা। এ অবস্থাতেই আচমকা তার মনে আসে মা নদীর দিকে চলে যায়নি তো! শহরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া নদীটি এখন পানিভর্তি। মা যদি এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে সেদিকে চলে যায় আর মনের ভুলে পানিতে নেমে পড়ে! এই ভাবনা তাকে আরো অস্থির করে দেয়। সাথে সাথেই সমস্ত ভয়কে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আর শূন্যতাকে বিদীর্ণ করে ঘুমন্ত শহরের রাস্তায় দৌড়তে থাকে নদীর উদ্দেশ্যে। এ দিকটা অন্ধকারে ঢাকা কেননা শহরের আলো এ পর্যন্ত এসে পৌঁছয় না। তাই চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে কিছু দেখা যায় না। যদিও জানে না মা পানিতে পড়েছে কি না, পড়লেও জীবিত আছে কি না তবু মাকে পাওয়ার আশা বুকে ঝুলিয়ে সানোয়ার নদীর স্রোতের দিকে হাঁটতে থাকে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক বইকথা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ