বাংলার প্রথম সার্কাস দল ‘গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’র কাহিনি


অষ্টাদশ শতকে বাংলার প্রথম সার্কাস দল তৈরি করে ইংরেজদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছিলেন একজন ‘প্রফেসর’, প্রিয়নাথ বসু  (জন্ম: ১৮৬৫ - মৃত্যু: ২১ মে ১৯২০) 

এক বাঙালি কিনা সার্কাস দলের মালিক! তাও আবার পরাধীন ভারতবর্ষে! হ্যাঁ, পরাধীন ভারতবর্ষে অষ্টাদশ শতকে সার্কাস দল খুলে ইংরেজদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন যে বাঙালি, তাঁর নাম প্রিয়নাথ বসু।

যদিও বাঙালির সার্কাসে প্রথম হাতেখড়ি হিন্দুমেলা-র প্রতিষ্ঠাতা নবগোপাল মিত্রের হাত ধরে। নবগোপালবাবুর 'ন্যাশনাল সার্কাস' প্রথমে খেলা দেখাত ঠনঠনিয়ায়। পরে তা নবগোপালবাবুর বাড়িতে উঠে যায়। সেখানে জন্তু-জানোয়ার বলতে ছিল একটি মাত্র টাট্টু ঘোড়া। নবগোপালবাবুর সেই সার্কাসে বিভিন্ন ধরনের জিমন্যাস্টিকসের খেলা দেখানো হত, যেকারণে অনেকেই ‘সার্কাস’ বলতে নারাজ। 

এরপর দু-চারজন ইংরেজ ও  ইউরোপীয়কে সঙ্গে নিয়ে নবগোপাল মিত্রের জামাই রাজেন্দ্রলাল সিংহ ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস’ নামে একটি সার্কাস দল তৈরি করেন। মির্জাপুরে শামিয়ানা টাঙিয়ে এই দল সার্কাস দেখাত।

কবি, নাট্যকার মনমোহন বসু নবগোপাল মিত্রের হিন্দুমেলার অন্যতম সংগঠক ছিলেন। মনমোহন বসুর নাটক অভিনীত হত ন্যাশনাল থিয়েটারেও। তাঁর গানও তখন বেশ জনপ্রিয়। প্রতিভাবান এই গুণী মানুষটির পুত্র প্রিয়নাথ বসু। 

প্রিয়নাথের ছিল শরীরচর্চার শখ। নিয়মিত ব্যায়াম করতেন, কুস্তির আখড়ায় যেতেন। সেসময় আহিরীটোলার গৌরহরি মুখোপাধ্যায় নামে এক ব্যায়ামশিক্ষক কলকাতার বহু জায়গায় জিমনাস্টিকসের আখড়া স্থাপন করেছিলেন। সবকটি তাঁর একার পক্ষে দেখাশোনা করা আর সম্ভব হচ্ছিল না। সে-কারণে তিনি কয়েকটি আখড়ার ভার নিজের ছাত্রদের হাতে ছেড়ে দিলেন। গৌরহরিবাবুর প্রিয় ছাত্র ছিলেন প্রিয়নাথ। প্রিয়নাথও পেলেন বেশ কিছু আখড়ার দায়িত্ব।

গৌরহরিবাবুর আখড়া দেখাশোনার পাশাপাশি, প্রিয়নাথ নিজেও স্বতন্ত্র কিছু আখড়া স্থাপনের উদ্যোগ নিলেন। যার প্রথমটি তৈরি হল প্রিয়নাথের নিজের বাড়ির কাছে, কর্নওয়ালিস স্ট্রীটে। তারপর সিমলা থেকে নেবুতলা পর্যন্ত প্রিয়নাথের উদ্যোগে গোটা পঞ্চাশেক আখড়া তৈরি হল। সবকটি আখড়াতেই নিয়মিত ব্যায়াম শেখাতে যেতেন প্রিয়নাথ।

একদিকে এতগুলি আখড়ার দায়িত্ব, অন্যদিকে সার্কাসের দল খোলার অদম্য বাসনা - এই দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে প্রিয়নাথ বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। প্রিয়নাথ নিজে ততদিনে পেশাদার জিমনাস্টিক খেলোয়াড় হয়ে উঠেছেন। এদিকে ছেলে জিমনাস্টিককে পেশা হিসেবে নেওয়ায় পিতা মনমোহন অসন্তুষ্ট। তিনি প্রিয়নাথকে সার্কাস দল খোলার ব্যাপারে কোনোপ্রকার সাহায্য করতে রাজি হলেন না। কিন্তু প্রিয়নাথ তাতে এতটুকু দমলেন না। বাড়ির মেয়েদের থেকে সাহায্য চাইলেন। বন্ধুবান্ধব, এদিক-ওদিক থেকে কিছু টাকা যোগাড় করে একদিন সার্কাস দল গড়ার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে প্রিয়নাথ বাড়ি ছাড়লেন।

কিছু জিমনাস্টিকস খেলোয়াড়, অদম্য ইচ্ছা আর সামান্য কিছু পয়সাকে সম্বল করে প্রিয়নাথ বাড়ি ছেড়ে বের হলেন। জিমনাস্টিক দলটিকে নিয়ে বিভিন্ন  জেলার জমিদার বাড়িতে খেলা দেখিয়ে বেড়াতে লাগলেন তিনি। যদিও আয়োজন খুবই সামান্য।

তাঁবু নেই, গ্যালারি নেই। বসার ব্যবস্থা বলতে বাঁশের মাচা, তা নাহলে মাটিতে পাতা চাটাই। আলোর বন্দোবস্ত হল বাঁশের মাথায় সরা বসিয়ে তাতে আগুন জ্বালিয়ে। খেলা বলতে শুধুই জিমনাস্টিকস। আর তাতেই মজে গেল গ্রাম বাংলার মানুষজন। বেশ ভালো রোজগার হতে লাগল প্রিয়নাথের। গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক মানুষজন দেখল বাঙালির প্রথম সার্কাসের খসড়া।

প্রিয়নাথ যখন কলকাতা ফিরলেন, হাতে অনেক টাকা। ফিরেই রোজগারের পয়সা দিয়ে তাঁবু, আলো ও সার্কাসের প্রয়োজনীয় সমস্ত সরঞ্জাম কিনলেন। ভালো কসরৎ জানা দু-একজন পেশাদার খেলোয়াড়কে দলে নিলেন। একজন হিসেবরক্ষকও নিযুক্ত করলেন। দলের নাম দিলেন "Professor Bose’s Great Bengal Circus" - বাঙালির প্রথম সার্কাস দল।

দলের নামের সঙ্গে 'প্রিয়নাথ বসু' অবধি ঠিক ছিল, কিন্তু 'প্রফেসর' কেন? প্রিয়নাথ তো কোনদিন অধ্যাপনা করেননি, তবে এই ‘প্রফেসর’ কোথা থেকে এল ? শোনা যায়, কলকাতার কোনো এক অনুষ্ঠানে বড়লাট লর্ড ডাফরিন প্রিয়নাথের আখড়ার ছেলেদের খেলা দেখছিলেন। খেলা দেখে আনন্দিত বড়লাট হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেন 'Who is the Proffessor?' ছাত্ররা তাদের গুরু প্রিয়নাথের নাম জানায়। প্রিয়নাথ হয়ে যান 'প্রফেসর প্রিয়নাথ'।

সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠল অচিরেই। কে বেশি ভালো দল - 'গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস' নাকি 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস'? গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাসের অংশীদার রাজেন্দ্রলাল সিংহ বাঙালি হলেও, মূল পরিচালক কিন্তু ছিল বিদেশি। খেলোয়াড়দের মধ্যেও বেশিরভাগই ছিলেন অন্য দেশের। পাশাপাশি, গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের মালিক, পরিকল্পনা, পরিচালনা সবকিছুর মূলে ছিলেন একজন বাঙালি - প্রিয়নাথ বসু। আর খেলোয়াড়রা প্রায় সকলেই ছিলেন ভারতীয়।

গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস নানা লড়ায়ের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করে। প্রথমে বাংলার নানা জায়গায় খেলা দেখিয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে তারা। তারপর ধীরে ধীরে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে খেলা দেখাতে শুরু করে।

এরপর শুরু হয় রাজা মহারাজাদের আমন্ত্রণে তাঁদের রাজবাড়িতে গিয়ে খেলা দেখানো। গোয়ালিয়রের মহারাজার প্যালেসে খেলা দেখাতে যায় প্রিয়নাথের দল। মহারাজ প্রিয়নাথের নিষ্ঠা দেখে মুগ্ধ হন ও আর্থিক সাহায্য করেন। সেই বছরই নভেম্বর মাসে রেওয়ার মহারাজা সার্কাস দেখে খুশি হয়ে প্রিয়নাথের দলকে দুটি বাঘ উপহার দেন। এভাবে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে প্রিয়নাথের সার্কাস দলটি।

কয়েক বছরের মধ্যেই গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস ভারতবিখ্যাত হয়ে ওঠে। দেশীয় সংবাদপত্রগুলিও প্রভূত প্রশংসা করে এই দলের। যা দেখে ব্রিটিশ সরকারের চোখ কপালে উঠে যায়। এক বাঙালি কিনা সার্কাসেও তাদেরকে টেক্কা দিয়ে দিল। এ যেন পরাধীনতার বিরুদ্ধে আরেক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ।

শোনা যায়, সে সময় খুব কম করদ রাজ্য ছিল যেখানে গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস খেলা দেখায়নি । ভারত ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, জাভা সহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে দল নিয়ে গিয়েছিলেন প্রিয়নাথ। বাঙালির সাফল্যের ধ্বজা উড়িয়েছিলেন চারদিকে। বাংলার ইতিহাসে সেও এক অধ্যায় বটে! 

তথ্যসূত্র - বঙ্গদর্শন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ