মহারাজা শুদ্ধোদন কর্তৃক চারবার নিজ পুত্র গৌতমকে প্রণামকাহিনি


প্রণাম তোমায় শাক্যপুত্র

বৌদ্ধশাস্ত্র মতে কপিলাবস্তুর মহারাজা শুদ্ধোদন চারবার নিজ পুত্র গৌতমকে প্রণাম করেছিলেন।

প্রথম প্রণাম:

প্রায় আড়াই হাজার বছরেরও আগে সদ্যোজাত সিদ্ধার্থকে কোলে তুলে নিয়ে শাক্যকুল-গুরু মহর্ষি অসিত তাঁকে নির্নিমেষে দেখছেন। ভবিষ্যৎবাণী করলেন তখনই— জাতক সংসারে আবদ্ধ থাকলে হবেন ত্রিভুবনজয়ী রাজচক্রবর্তী। আর যদি কোনদিন মুন্ডিত হয় তাঁর মস্তক, অঙ্গে ওঠে পীত অজিন, তাহলে তিনি হবেন জগৎত্রাতা যুগাবতার। শ্মশ্রু-সমন্বিত মহর্ষি অসিতের মুখে আনন্দ ও বিষাদের অপূর্ব সংমিশ্রণ। কিন্তু বিষাদ কেন? ঈশান চন্দ্র ঘোষ মহাশয় বুদ্ধদেবের জীবনীতে লিখেছেন—   এই ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করার পর মহর্ষি অসিতের শীর্ণ গাল বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে। মহারাজ শুদ্ধোদন বিস্মিত। প্রশ্ন করলেন—  মহর্ষি আপনি কাঁদছেন? কিন্তু কেন? উত্তরে মহর্ষি বলেছিলেন— মহারাজ এই সদ্যোজাত শিশু যখন বড় হয়ে পরম সত্যের সন্ধান পাবে তখন আমি থাকব না। অনেক আগেই দেহরক্ষা করব। এঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করার সৌভাগ্য থেকে আমি বঞ্চিত হলাম। শুধু এটুকুই আমার কষ্টের কারণ।

একথা বলে সেই সদ্যোজাত শিশুর সম্মুখে মহর্ষি অসিত ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলেন। তখন উপস্থিত অন্যান্য ঋষিরাও শিশু কে প্রণিপাত করলেন। মহারাজ শুদ্ধোদন বিস্ময়াহত। অতঃপর তিনিও প্রণাম করলেন নিজ পুত্রকে।

দ্বিতীয় প্রণাম:

কপিলাবস্তুতে সেযুগে মহা আড়ম্বরে হলকর্ষণ উৎসব হত। উৎসব-মগ্ন নরনারীর মিছিলে তরুণ সিদ্ধার্থকে সেখানে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু হলকর্ষণের বলিবর্দদের কষ্টের কথা চিন্তা করে বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন রাজপুত্র। শেষে উৎসব ক্ষেত্র থেকে সরে  গিয়ে একটি গাছের ছায়ায় ধ্যানমগ্ন হয়ে বসলেন সিদ্ধার্থ। মহারাজ সেটা লক্ষ করলেন। বিস্ময়ে আরও লক্ষ করলেন,সমস্ত দিনে গাছের ছায়া একটুও সরলো না। ধ্যানস্তিমিত গৌতমকে রৌদ্রতাপ থেকে রক্ষা করতে  বৃক্ষ তার ছায়া কে অপসারিত হতে দিল না। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে বিস্ময়াবিষ্ট শুদ্ধোদন তরুণ পুত্রকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। 

তৃতীয় প্রণাম:

মহারাজ শুদ্ধোদনের কাছে সংবাদ পৌঁছলো যে তাঁর গৃহত্যাগী পুত্র সিদ্ধার্থ বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন এবং বর্তমানে রাজগৃহে অবস্থান করছেন। পুত্র দর্শনে ব্যাকুল রাজা একজন বিশ্বস্ত রাজানুচর এবং অমাত্য কালুদায়িকে পাঠালেন পুত্রকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসতে। সুসজ্জিত করা হল কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদ সন্নিকটস্থ ন্যগ্রোধারাম বিহার। ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় সন্ন্যাসীর স্থান নৃপতির উর্ধ্বে। রাজাই সন্ন্যাসীকে প্রণাম  করে থাকেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সন্ন্যাসী যে তাঁর প্রাণাপেক্ষা  প্রিয় পুত্র, সেই সিদ্ধার্থ, সেই গৌতম যাকে বুকে পিঠে করে মানুষ করেছেন তিনি। তাহলে? দীর্ঘ অদর্শনের পর পুত্র পিতা কে প্রণাম করবেন, না নৃপতি প্রণাম জানাবেন মহাসন্ন্যাসীকে?

একটি অলৌকিক ঘটনায় সমস্যার সমাধান হল আপনা থেকেই। শুদ্ধোদন বিস্মিত হয়ে দেখছেন, তাঁর সঙ্গে মিলিত হবার উদ্দেশ্যে বুদ্ধদেব অগ্রসর হয়ে আসছেন ভূমি স্পর্শ না করেই। বায়ু তাড়িত মেঘের মত যেন শূণ্যে ভেসে আসছেন তিনি। স্তম্ভিত, স্নেহান্ধ মহারাজ লুটিয়ে পড়লেন সন্ন্যাসীর চরণমূলে। 

চতুর্থ বা শেষ প্রণাম: 

এ-পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার মুহূর্তে  শুদ্ধোদন শেষবারের মত তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের সাক্ষাৎ চাইছিলেন। কিন্তু তথাগত তখন বহু দূরদেশে অবস্থান করছেন। এখনই তাঁর পক্ষে সেখানে আসা অসম্ভব। তাই তাঁর গোপন মনোবাসনা ব্যক্ত করলেন না। অশ্বঘোষের মতে— একেবারে শেষ মুহূর্তে মহারাজ দেখতে পান, সেই মহাসন্ন্যাসী সূক্ষ্ম শরীরে তাঁর শয্যাপার্শ্বে এসে দণ্ডায়মান হয়েছেন। ব্যাকুল, অসুস্থ মহারাজ তৎক্ষণাৎ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন বুদ্ধদেবকে, তাঁর পুত্রকে, আর ওঠেননি। 

[নারায়ণ সান্যালের লেখা থেকে নির্বাচিত অংশ প্রকাশ করা হলো।]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ