পঁচিশে বৈশাখের দিনলিপি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুর্লভ ছবি

লিখেছেন: অরিন্দম চক্রবর্তী

পঁচিশে বৈশাখ। আপামর বঙ্গসমাজ ঠাকুর পুজোয় সামিল। কলকাতা থেকে দূর মুম্বাইতে বসে এর আঁচ পাওয়া মুশকিল। পশ্চিমবঙ্গজুড়ে উত্তন্ডমার্তন্ড ভাবে কোমর বেঁধে সবাই নেমে পড়েছে ভোট ভুলে (পঞ্চায়েত)। এখন অনুষ্ঠানগুলো পলিটাক্যাল সংযোগও বটে।

এইসব দিনে যা হয়—স্মৃতিমেঘে ঢাকা পড়লুম—এইমাত্র আমার জানালা দিয়ে দেখলুম একজন ট্যাক্সিচালক তার যত্মের যান থেকে নেমে প্লাস্টিকের বোতল থেকে ঢকঢক করে গলায় মুখে জল ঢালছে। ভীনদেশী মানুষ, ও কি জানে রবীঠাকুরের জন্মদিন— আর আমি ক্রমশ ৩৫/৪০ বছর পিছিয়ে যাওয়া একজন। 

সুকুমারদার মাইকের ক্যাঁকোফোনিক আওয়াজে স্মৃতি — ধুলো ঝেড়ে নিয়ে চারপাশ দ্যাখে। একে অপরে চাক্ষিক মোকাবেলা। বেল রজনীগন্ধা-গন্ধে চারিদিক সোরগোল—শতসহস্র নদীমাতৃক-মন প্রবল বেগে হাওয়া কেটে —নুড়িপাথর সরিয়ে বয়ে যেতে থাকে। তাকে রোখে কোন শা... না আজকের দিনে নয়—পাপ হবে।

গত একমাসের প্রবল পরিশ্রমের সার্থক রূপ দিতে হবে আজ। পাশের পাড়া ফরডাইস লেন —গান নাচ আবৃত্তিতেই আবদ্ধ—আর আমরা— নটীরপূজা, হরিখেলা, ডাকঘর —জমজমাট—হুঁ হুঁ বাবা পারবে কেন ...নাহ্, একদিনও আমাদের রিহার্সালে ওদের ঢুকতে দিইনি--কভি নেহি--ইজ্জতের ব্যাপার— ওরা যা হ্যাংলা— আমাদেরটা দেখে আবার না...! সে যাক, আমার মা-ই এই নাটকের কান্ডারী। সগ্গে গিয়ে, আজ নিশ্চই এইসব স্মৃতি হাতড়াচ্ছে—নন্দনকাননের কোথায় স্টেজ বাঁধা হবে—মাইক কোথায় বসবে—কত পিস ফুলমালা আসবে—কজন কোথায় কীভাবে দাঁড়াবে—এসবের তদারকি করছে, আর ইন্দ্রকে পার্ট ভুলে যাওয়ার জন্য উস্তুমমুস্তুম দিচ্ছে— বিধাতাকে গারগল ও লবঙ্গ বিধান —লক্ষী সরস্বতী টান টান—গনেশ ঘন ঘন বাহ্যে যাচ্ছে— এটাকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল!…

‘ডাকঘর’-এ অমল করে বিশেষ নাম কুড়িয়েছিলুম— তার মধ্যে সহানুভূতি প্রাবল্যই ছিল বেশি। 'হরিখেলা' করে পরের দিন তো এই উড়ি কি সেই উড়ি— পিঠচাপড়ানি জুটেছিল বেশ। আর কাউকে না পেয়ে পাড়ার আদা ব্যবসায়ী গোবিন্দকাকু আমাকেই রসগোল্লা সন্দেশ খাওয়ানোর মনস্থির করে ফেলেছিলেন—

শেষে ওর দোকান-কর্মচারী— একবস্তা পচা আদা বেরিয়েছে, এমন দুঃসংবাদ দেওয়ায় ব্যাপারটা বেশিদূর গড়ায়নি। আদার পচাসংবাদ শুনে গোবিন্দ কাকুর মুখ থেকে তিনটে শব্দ বেরিয়েছিল— ‘হালার পো হালা’।

সে যাহোক, নাটক ছাড়াও থাকত গান। না থামা গায়কও ছিলেন; একটা গানের শেষ কলি থেকে পরবর্তী গানের প্রথম কলিতে কখন চলে যেতেন... ব্যাপারটা এতই চুপিচুপি ঘটতো... দর্শক শ্রোতা তো কোন ছাড় —তবলিয়া তার তাল গুলিয়ে ডবল দাদরায় ঢোল বাজাতে শুরু করত —দর্শক গায়কের প্রবল আগুপিছু শরীর ঝাঁকুনিতে বিমোহিত হয়ে ঝালমুড়িতে মনোনিবেশ করত —ব্যবস্থাপক দাদারা ধুতির কোঁচা সামলে স্টেজের কোনা থেকে মাইক বাঁচিয়ে— ‘নেমে আসুন’ হাতজোড় অনুনয়ে নিজেরা নিজেদের ধৈর্যের পরীক্ষা দিত। শেষে অনিচ্ছায় স্টেজ থেকে নেমে আসার সময়ে আক্ষেপে গায়ককে বলতে শুনেছি— ‘রোদন ভরাটা তো গাওয়াই হলনা আশ্চর্য এত তাড়া দিলে চলে…!’ যদিও তার বরাদ্দ দুটো গান কখনযে সাঁতরে সাতে পড়ছিল... উনিও বুঝতে পারেননি, ভক্তি এমনই জিনিস! কোন একবার... মনে আছে পাড়ার বাবলাদা তার নয় বছরের ছেলে বাপ্টুকে স্টেজে প্রায় তুলে দিয়েছিল রবীন্দনাদ ঠাকুরের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটা গাওয়ার জন্য— শেষে চা-ওয়ালা শিবুদার হাতের হ্যাঁচকা টানে সে যাত্রা রক্ষে ।

এছাড়াও ছিল চ্ছেদহীন কবিতা। কখন ‘সোনার তরী’ পাল তুলে ‘প্রশ্ন’-এর দরজা খটখটাচ্ছে —শেষে অনেক অনুরোধে বিজয়ী বীরের হাসি হেসে আবৃত্তি শিল্পী ক্ষমা করেছিল বটে।

আজ হাওয়ায় হাওয়ায় সেসব জ্যোতিচিহ্নহীন স্মৃতির পাপড়ি আমার বারান্দা জানালা বেয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ছে— একে একে তাদের আমার গোপন বাক্সে আবার এক বছরের জন্য বন্দী করে ফেলব। বছরের মাঝখানেও মাঝেমধ্যে খুলে ফেলতে পারি, সেই জানালা— যেখানে অমল বসে থাকত— তীব্র আকাঙ্ক্ষায়।

পঁচিশে বৈশাখ, ১৪২৫

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ