এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করেও উপেক্ষিত বাঙালি গণিতবিদ রাধানাথ শিকদার

এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করলেও রাধানাথের কৃতিত্বকে ব্রিটিশ সরকার চেপে যায়


বাঙালি গণিতবিদ রাধানাথ শিকদার হয়েছিলেন উপেক্ষিত । মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করলেও তাঁর কৃতিত্ব ব্রিটিশ সরকার চেপে যায়!

দেরাদুন শহর।

সে সময়ে সাধারণ মানুষকে উচ্চপদস্থ ইংরেজ অফিসাররা জোর করে পয়সা না দিয়ে পরিশ্রম করিয়ে নিত। এটাই নাকি ছিল রেওয়াজ। কিন্তু অমানবিক এই কাজের প্রতিবাদ করলেন এক সাহসী বাঙালি যুবক। যিনি সেই সময় দেরাদুনের গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অফিসে চাকুরিরত। এই যুবকের নাম  রাধানাথ শিকদার।

রাধানাথের পরিচারক-কে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার এইচ ভ্যানসিটার্ট সাহেব বিনা পয়সায় তাঁর নিজের মালপত্তর বহন করিয়ে নিচ্ছিলেন। যা দেখে রাধানাথ আপত্তি করেন এবং ম্যাজিষ্ট্রেটের মালপত্তর আটকে রাখেন। শুধু তাই নয়, ম্যাজিস্ট্রেটকে সশরীরে তাঁর কাছে আসতে বাধ্য করেন। ম্যাজিষ্ট্রেট এলেন। উভয়ের মধ্যে হল উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়।

রাধানাথ তো সাহেবের মালপত্তর ফেরত দিয়ে দিলেন কিন্তু ক্রোধে অগ্নিশর্মা ম্যাজিস্ট্রেট রাধানাথের বিরুদ্ধে দিলেন মামলা ঠুকে। মামলায় হারলেন রাধানাথ।  জরিমানা হল দু'শো টাকা। সেই আমলে দুশো টাকা মানে অনেকটাই অর্থ। যাই হোক, রাধানাথ কোনোরকম গ্রাহ্য না করে জরিমানার দু'শো টাকা মিটিয়ে দিলেন। মামলা মিটল। কিন্তু রাধানাথের এই প্রতিরোধের ফলে ইংরেজদের এই বেগার খা‍টিয়ে নেওয়ার মতো অমানবিক কাজ সেখানে চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল।

কলকাতার জোড়াসাঁকোর ছেলে রাধানাথ। পিতা তিতুরাম। রাধানাথের পড়াশোনা শুরু কলকাতার ৪৮নম্বর চিৎপুর রোডের ‘ফিরিঙ্গি’ কমল বসুর বিদ্যালয়ে। পরে ভর্তি হন হিন্দু কলেজে। হিন্দু কলেজেই রাধানাথ ইংরাজির শিক্ষক হিসেবে পান ইয়ং বেঙ্গলের ডিরোজিওকে। আর গণিতের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ড. জন টাইটলারকে। এই সময়ে আইজ্যাক নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া’ সমগ্র ভারতে প্রথম চর্চা করেছিলেন রাধানাথ শিকদার এবং রাজনারায়ণ বসাক আর সেটা সম্ভব হয়েছিল তাঁদের শিক্ষক ড. টাইটলারের জন্যই।

হিন্দু কলেজে পড়াকালীন গণিত বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে মুগ্ধ করে। ছাত্র থাকাকালীন তিনি নিজেই জ্যামিতির একটি সম্পাদ্য সমাধানের পদ্ধতি আবিষ্কার করে সবাইকে চমকে দেন।

এদিকে কর্নেল উইলিয়াম ল্যাম্বটনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ভারতীয় উপমহাদেশে গ্রেট ট্রাইগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভের কাজ শুরু হয়। হায়দ্রাবাদে ল্যাম্পটনের প্রধান সহকারী হয়ে কাজ শুরু করেন জর্জ এভারেস্ট। তাঁদের সঙ্গে ছিল একটি বড় থিয়োডোলাইট যন্ত্র। যার সাহায্যে ল্যাম্বটন ও জর্জ এভারেস্ট জিটিএস পদ্ধতিতে এই উপমহাদেশে জরিপের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন।

এভারেস্ট এবং ল্যাম্পটন বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বুঝতে পেরেছিলেন, নেপালের জঙ্গলে ওই যন্ত্রকে প্রায় একত্রিশ ফুট উচ্চতায় না বসাতে পারলে পর্বতশৃঙ্গগুলির উচ্চতা পরিমাপ করা বেশ কঠিন কাজ হবে।

ইতিমধ্যে কাজ চলতে চলতেই ল্যাম্বটন মারা যান। যার ফলে ব্রিটিশ সরকার জর্জ এভারেস্টকেই সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সুপারিন্টেনডেন্ট নিযুক্ত করে। ভারতের সার্ভেয়র জেনারেল জর্জ এভারেস্ট কাজের জন্য তখন একজন দক্ষ, তরুণ গণিতবিদকে খুঁজছিলেন। তাঁর বন্ধু ড. জন টাইটলার তাঁর প্রিয় ছাত্র রাধানাথের নামটি সুপারিশ করে দিলেন এভারেস্টের কাছে। টাইটলারের সুপারিশে এভারেস্ট রাধানাথকে নিয়োগ করলেন। রাধানাথ সার্ভেয়র জেনারেলের অফিসে মাসে ৩০টাকা বেতনের চাকরিতে যোগ দিলেন।

ধীরে ধীরে রাধানাথ গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্ভেয়র হন এবং দেরাদুনের সিরোন্‌জ অঞ্চলে জরিপের কাজে যুক্ত হন। এই জরিপের কাজের জন্য এভারেস্ট বেশ কিছু নিজস্ব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। মেধাবী রাধানাথ এভারেস্টের কিছু পদ্ধতির পরিমার্জন করে দিলেন। এভারেস্ট খুশি হন রাধানাথের ওপর।

জর্জ এভারেস্টই প্রথম ভারতের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বিশাল এলাকা সম্বলিত পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর উপর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সার্ভের কাজ শুরু করেন। সার্ভে করতে করতে জর্জ সিদ্ধান্ত নেন হিমালয়ের সবচেয়ে উচ্চ শৃঙ্গের অবস্থান তিনি নির্ণয় করবেন।

সুযোগ সুবিধাবিহীন, পদে পদে বিপদ থাকা সত্ত্বেও জর্জ এই কাজটি এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি কাজটি শেষ করতে পারলেন না। কারণ তার আগেই চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার সময় উপস্থিত হল। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর এভারেস্ট চলে গেলেন ইংল্যান্ডে এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।

জর্জ এভারেস্ট অবসর নেওয়ার আগে তাঁর ‘The Great Arc of India’-র কাজটি সম্পূর্ণ করেন। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং ভয়ঙ্কর সমস্যাসঙ্কুল একটি জরিপের কাজ। এভারেস্ট অবসর নেওয়ার পর তাঁর জায়গায় এলেন অ্যান্ড্রু ওয়াহ। এদিকে রাধানাথ শিকদার দেরাদুনের সার্ভে অফিস থেকে কলকাতার সার্ভে অফিসে বদলি হয়ে গেলেন।

ভাবলেও অবাক হতে হয়, এই পাঁচ বছরের মধ্যে হিমালয় পর্বতের প্রায় ঊনআশিটি শিখরের উচ্চতা নির্ণয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। এগুলির মধ্যে একত্রিশটি শিখরের নামকরণ হয়েছিল স্থানীয় নামে আর বাকিগুলিকে রোমান অক্ষরের সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত করা হতো। 

অ্যান্ড্রু ওয়াহ হিমালয় পর্বতমালার পূর্বপ্রান্তে একটি নতুন শৃঙ্গ আবিষ্কার করেন। তিনি ধারণা করেন এর উচ্চতা তখন পর্যন্ত জানা পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার থেকে বেশি হতে পারে। এর নাম রাখা হল Peak-XV বা 'পিক ফিফটিন'। হিমালয় পর্বতের সব শৃঙ্গের উচ্চতার মাপগুলি তখন জমা পড়ছিল কলকাতার গণনা বিভাগে। যার নেতৃত্ব ছিলেন রাধানাথ। জমা পড়া পরিসংখ্যানের মাঝেই একদিন রাধানাথ আবিষ্কার করলেন এই পিক ফিফটিনই পৃথিবীর সবথেকে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ। তাঁর হিসাব অনুযায়ী পিক ফিফটিনের উচ্চতা ২৯,০০২ ফুট। তিনি দেরাদুনে অ্যান্ড্রু ওয়াহকে বিষয়টা জানালেন। রাধানাথের মনে হল এ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। ওয়াহ সাহেব কাউকে কিছু না জানিয়ে দেরাদুনে কর্মরত এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান হেনেসি সাহেব ও তাঁর সহযোগীদের বিষয়টা ক্রসচেক করতে বললেন। স্বীকৃতি পেল রাধানাথের কৃতিত্ব।

সে বছর রয়্যাল জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটি ঘোষণা করল 'পিক ফিফটিন'ই বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গ।

"সাধারণত পর্বতের নাম সেই অঞ্চলের মানুষ যে নামে ডাকে সে নামেই নির্দিষ্ট হবে"- এরকম এক নিয়ম চালু করেছিলেন জর্জ এভারেস্ট নিজেই। সেই অর্থে সদ্য আবিষ্কৃত 'পিক ফিফটিন'কে নেপালীরা ডাকত ‘সাগরমাথা’ বলে আর তিব্বতীরা ডাকত 'কুমুলুংমা' নামে, যার অর্থ 'পৃথিবীর জননী'। অন্যদিকে তখন নেপাল ও তিব্বত বিদেশীদের জন্যে একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। তার সাথে দু'দেশে দুধরনের নাম। যে কারণে নামকরণ নিয়ে বেশ সমস্যা দেখা দিল।
হিমালয় পর্বতমালার অন্য শৃঙ্গগুলোকে তাদের আঞ্চলিক নামেই চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু হিমালয়ের এই সর্বোচ্চ শৃঙ্গটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর, ওয়াহ সাহেব যখন এর নির্দিষ্ট একক কোনো আঞ্চলিক নাম পেলেন না তখন ওয়াহ সাহেব আঞ্চলিক নামের প্রতি আর উৎসাহ না দেখিয়ে লন্ডনে রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির কাছে লিখিতভাবে সমস্যার কথা জানালেন এবং প্রস্তাব দিলেন তাঁর গুরু ‘জর্জ এভারেস্ট’-এর নামে এই সর্বোচ্চ পর্তশৃঙ্গের নামকরণ করার জন্য।

প্রস্তাব গ্রাহ্য হল। শোনা যায়, প্রচারবিমুখ এভারেস্ট নিজে কিন্তু এই প্রস্তাবে একেবারেই সম্মত ছিলেন না। তিনি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। কিন্তু তাঁর  বিরোধিতাকে কেউ খুব একটা আমল দিল না। 'পিক ফিফটিনে'র নাম হয়ে গেল 'মাউন্ট এভারেস্ট'। ব্রিটিশ সরকার জর্জ এভারেস্টকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করে। মাউন্ট এভারেস্ট স্বীকৃতির এক বছর পরই জর্জ এভারেস্ট মারা যান। 

দুঃখের বিষয় এটাই, এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করলেও রাধানাথের কৃতিত্বকে ব্রিটিশ সরকার চেপে যায়।

সার্ভে বিভাগের এক ম্যানুয়াল প্রকাশিত হত, নাম ‘A Manual of Surveying for India’ যার লেখক ছিলেন, আর স্মিথ এবং এইচ এল থুইলিয়ার। এই গ্রন্থে তাঁরা রাধানাথের অবদান এর কথা উল্লেখ করলেন প্রথম। কিন্তু তাঁরা তাঁদের গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণে রাধানাথের নাম মুছে দিলেন। 'ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া' নামক সংবাদপত্রে এই ঘটনাকে 'মৃতের উপর ডাকাতি' বলে কটাক্ষ করা হয়।

রাধানাথের আবিষ্কারের কথা প্রথম প্রকাশ্যে আনেন ভারতের প্রাক্তন সার্ভেয়ার জেনারেল কর্নেল সিডনি জেরাল্ড বুরার্ড। বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নেচার’-এর একটি সংখ্যায় ‘‘Mount Everest : The Story of a Long Controversy’’ শিরোনামে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক নিবন্ধ লেখেন। তারপরই সারা বিশ্ব জানতে পারে এই অসাধারণ গণিতবিদ সম্পর্কে।

রাধানাথ একজন সাহিত্য অনুরাগীও ছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। প্যারীচাঁদ মিত্রকে তিনি 'মাসিক পত্রিকা' প্রকাশে সহায়তা করেন। কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করার পর তৎকালীন জেনারেল এসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশনে  গণিতের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন রাধানাথ। পরে জার্মানির “Natural History Society of Bavaria-র সম্মানজক সদস্যপদ পান। বিয়ে করেননি তিনি। সংসার বন্ধন মুক্ত ছিলেন গণিতজ্ঞ রাধানাথ।

শেষ জীবনে রাধানাথ থাকতেন চন্দননগরের গোন্দলপাড়ার গঙ্গার ধারে তাঁর নিজের বাগানবাড়িতে। সেখানেই মারা যান রাধানাথ।

তথ্যসূত্র - বঙ্গদর্শন 

ঋণ :১|Radhanath Sikdar: Beyond the Peak- Ashis Lahiri   ২| Mount Everest: The Story of a Long Controversy. Author: Burrard  ৩|Who discovered Mount Everest?-Parke A. Dickey

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ