বাংলা মৌলিক থ্রিলার লেখার ক্ষেত্রে সমরেশ মজুমদার অসাধারণ ছিলেন

• হিল্লোল দত্ত

একটা সময় পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক বলতে এক নামে চিনতাম সুনীল-শীর্ষেন্দু-সঞ্জীব এই ত্রয়ীকে৷ পরে এই দলে যুক্ত হলেন সমরেশ, বসু নন, মজুমদার৷ নিজের শক্তিতেই তিনি অর্জন করে নিয়েছিলেন এই ক্ষমতা। বিষয়ের বৈচিত্র্য এবং পটভূমির বহুমুখিনতা তাঁকে সমসাময়িক আলোচ্য সাহিত্যিকদের প্রথম সারিতে তুলে আনে। তাঁর সৃষ্ট কিশোর গোয়েন্দা চরিত্র অর্জুন আনন্দমেলার শারদীয় পাতার আনন্দময় আকর্ষণ ছিল একদা। তে হি নো দিবস গতাঃ।

সমরেশ তসলিমার চরিত্রের আদলে আমাকে চাই নামের উপন্যাসে মোহর নামের একটি লড়াকু নারী চরিত্র গড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সবচে সেরা লড়িয়ে নারীচরিত্র অনেকের কাছে তাঁর সাতকাহন উপন্যাসের দীপাবলি। এছাড়া, তাঁর অনিমেষ-মাধবীলতা ট্রিলজির মাধবীলতা, গর্ভধারিণী উপন্যাসের জয়িতা সংগ্রামী, স্বাধীনচেতা, ও আদর্শবাদী আধুনিক নারী চরিত্র হিসেবে বাংলা সাহিত্যের নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে স্মর্তব্য হয়ে থাকবে। তবে তসলিমার প্রতি তিনি কিছু কটূক্তি করেন যাতে ঠিক সৌজন্যবোধ দেখানো হয়নি। একজন প্রবীণ সাহিত্যিক হিসেবে এক্ষেত্রে তিনি অসংযত ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। আশা করি, তসলিমা এর যথাযথ প্রতিদান দেবেন তাঁর মৃত্যুবারতায়।

নকশাল আন্দোলন, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ির, তথা উত্তরবঙ্গের ভূপ্রকৃতি ও চাবাগান তাঁর একাধিক লেখায় উঠে এসেছে। যদিও কারোর কারোর অভিযোগ, তিনি নকশাল আন্দোলন এবং চাবাগানের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেননি, বরং একটি কল্পিত রোম্যান্টিক আবহ তৈরি করেছেন।

বাংলাদেশের সাহিত্যের সাথে তাঁর যোগাযোগ ঠিক কতটা ছিল জানা না-গেলেও হুমায়ূন আহমেদ তাঁর বন্ধু ছিলেন এবং হুমায়ূনকে তিনি দেশ পত্রিকায় একটি প্রশংসাসূচক লেখা লিখে পশ্চিমবঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত করেছিলেন। শারদীয় দেশ পত্রিকায় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ছাপানোর ব্যাপারেও তিনি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে জানা যায়৷ তিনি এও খোলাখুলিভাবে বলেছিলেন যে হুমায়ূন আহমেদের মতো প্রতিভা তাঁর নেই।

সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষার ব্যবহার নিয়ে তাঁর কিছু আপত্তি ছিল। খাদ্যোপভোগ করার বেলায় মজা শব্দটি নিয়ে তিনি আপত্তি তুলেছেন যা বাংলাদেশের জনগণের মুখে বহুল প্রচলিত। এছাড়া, বাংলাদেশের সাহিত্যে প্রভূত আরবি-ফারসি শব্দ জোর করে আনা হচ্ছে বলে তাঁর অভিযোগ ছিল। ১৯৭১-এর পর এসব শব্দ ঢোকানো হয় বলে তাঁর অভিযোগ ছিল। এমনকি, তিনি বাংলা ভাষা প্রমিতকরণেরও প্রস্তাব করেছিলেন।

ব্যক্তিগতভাবে, আমি মনে করি, বাংলা মৌলিক থ্রিলার লেখার ক্ষেত্রে তিনি অসাধারণ ছিলেন। যদিও তাঁর কিছু কিছু লেখায় বিদেশি গল্পের ছাপ রয়েছে, তবুও তিনি চাইলে এই ধারাটিতে আরো অবদান রাখতে পারতেন৷ তাঁর আট কুঠুরি নয় দরজা নামের কল্পবিজ্ঞান থ্রিলারটি রুদ্ধশ্বাস চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল পড়ার সময়, যদিও শেষটা কেমন হতাশাজনক মনে হয়েছিল।

এই বহুপ্রজ লেখককে সামনাসামনি দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। চট্টগ্রামের বাতিঘরে তিনি এসেছিলেন সম্ভবত ২০১৩ বা ২০১৪-এর দিকে। বাতিঘরের স্বত্ত্বাধিকারী দীপংকর দাস আমায় সুযোগ দিয়েছিলেন তাঁর সামনে তাঁকে নিয়ে কিছু বলার। দ্রুত বলে সংক্ষেপে শেষ করেছিলাম।

সপ্তাখানেক আগে থেকে খবর পেয়েছিলাম, তিনি আইসিইউতে৷ শুনছিলাম, অবস্থার উন্নতি হয়েছে তাঁর। কিন্তু, শেষরক্ষা আর হল না। আজ তাঁর শেষযাত্রায় শুধু এটুকুই বলার, তাঁকে ভুলিনি।তাঁর সাহিত্যগুণের বিচার মহাকাল ও পাঠকেরাই করবে। তবে তিনি আমার জীবদ্দশায় অনেক পাঠকের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় থেকে যাবেন।

আজ রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী। তিনি অত্যন্ত গুণমুগ্ধ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের। অর্জুনকে তিনি একবার ভবিষ্যতে নিয়ে ফেলেছিলেন টাইম মেশিনে চড়িয়ে, জলপাইগুড়ি থেকেই। সেখানে দেখানো হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যৎ বঙ্গে ঈশ্বর হিসেবেই পূজিত ও বরণীয়।

সেই ঈশ্বরের পদতলেই তিনি আজ হয়তো আত্নোৎসর্গ করলেন।

[সমরেশ মজুমদারের মৃত্যুদিনে লিখিত]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ