‘আমি বাজারের আলু-পটল নই! তোমাদের মতো ফুলবাবুর জীবন আমার নয়।’ : সুচিত্রা মিত্র


১৯৬০ সাল৷ প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এলেন কলকাতা সফরে৷ দলীয় সমর্থকরা আনন্দ মিছিল করে বরণ করলেন তাঁকে। কিন্তু বিরোধীরা রাস্তায় নামলেন কালো পতাকা হাতে বিক্ষোভ জানাতে। সেদিন আকাশবাণীর লাইভ প্রোগ্রামে বাল্মীকি প্রতিভার গান গাইলেন তিনি৷ তিনি গাইছেন "কাজের বেলায় উনি কোথা যে ভাগেন, ভাগের বেলায় আসেন আগে"। কারও বুঝতে বাকি রইলনা, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করেই এই গান গেয়েছেন। ফলাফল - ছয় বছর আকাশবাণীতে গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গেল তাঁর। অবশ্য তাতে পাত্তা দেননি তিনি। নিজের কথাতে, "আমি বললাম, আমার বয়েই গেল।"

এক নামী রেকর্ডিং সংস্থাতেও এক বার খুব খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। রেকর্ডিং করতে গিয়েছিলেন। সেখানে এক আধিকারিক তাঁকে এমন কিছু বলেন, যা তাঁর পক্ষে খুব অশালীন এবং অবমাননাকর। রেকর্ডিং ছেড়ে বেরিয়ে সোজা বাড়ি। আসার আগে সেই ব্যক্তিকে ঝাঁঝিয়ে বলে এসেছিলেন, ‘‘মনে রাখবেন, আমি বাজারের আলু-পটল নই! এখানে আর কখনও পা দেব না।’’ খবর পেয়ে সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর কাছে। হাতেপায়ে ধরে ভুল স্বীকার করে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। 

সাতাশি বছরের জীবনে বেশির ভাগ সময় একলা চলতে হয়েছে বলেই বোধহয় অন্যের উপর নির্ভর করে চলা ধাতে ছিল না তাঁর। ঘরের কাজ, রান্নাবান্না সবই করতেন নিজের হাতে। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় এক অনুষ্ঠানে তাঁর কাছে জানতে চান, ‘‘তোমার কি শরীর খারাপ?’’ তিনি বলেছিলেন, ‘‘দ্বিজেন, এমন শরীর খারাপ আমার রোজই থাকে। কারণ আমি রান্না করে, বাসন মেজে, ঘর গুছিয়ে তবে গান গাইতে আসি। তোমাদের মতো ফুলবাবুর জীবন আমার নয়।’’

একদিন রবিতীর্থে গান শেখাচ্ছেন, একদিন ক্লাস চলাকালীন বোর্ডে স্বরলিপি লেখবার প্রয়োজনে একজন ছাত্রকে চক নিয়ে আসতে বলেন, সেই ছাত্র স্বাভাবিক ছন্দে চকের সঙ্গে ডাস্টারটিও এনে দিলে দেখামাত্রই রাগ করে বলেছিলেন, 'আমার ডাস্টার লাগে না।' সেই ছাত্রের কথায়, 'আমি তখন ভাবছি, এ তো একটা গান, প্রতিটি গানের স্বরলিপি লেখবার ক্ষেত্রে 'ডাস্টার লাগেনা'র মতন কথা বলার জন্য কতখানি সাহস আর জ্ঞান লাগে!’ 

রবীন্দ্র-যুগের বিশিষ্ট সাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের দুই পুত্র, তিন কন্যা। কন্যাদের মধ্যে কনিষ্ঠ সুচিত্রা মিত্র৷  চলন্ত ট্রেনে জন্মেছিলেন তিনি। ১৯২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, বিহারের গুজন্ডি স্টেশনের কাছে৷ ঝাড়খন্ডের অখ্যাত সেই রেলস্টেশনকে স্মরণে রাখার জন্য বাবা মা কন্যার নাম রাখলেন গজু। অনেকদিন পরে  শান্তিনিকেতনে তাঁকে সবাই চিনলেন গজুদি নামে‌। তিনি বাঙালির অতি প্রিয় সঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্র। 
নিজের জন্মের ঘটনাটিও ছড়ায় লিখে গেছেন...
শুনেছি, রেলগাড়িতে জন্মেছিলাম
দুই পায়ে তাই চাকা
সারাজীবন ছুটেই গেলাম
হয়নি বসে থাকা।
যাই যদি আজ উত্তরে ভাই
কালকে যাবো দক্ষিণে
পশ্চিমে যাই দিনের বেলা
রাত্তিরে ঘুরি পুবকে চিনে...!

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল সৌরীন্দ্রমোহনের। সেই আবহেই সুচিত্রারও বেড়ে ওঠা। সুর ছিল গলায়। ছোটবেলায় পঙ্কজ মল্লিকের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার হাতেখড়ি তাঁর। তার পরে সঙ্গীতভবনের বৃত্তি পেয়ে শান্তিনিকেতনে যাওয়া। তখন তিনি সতেরো। চার বছর সঙ্গীতভবনে ডিপ্লোমা কোর্স করেন তিনি। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ইন্দিরাদেবী চৌধুরানি, শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে।

কলেজে পড়ার সময় থেকে রাজনীতিতে আগ্রহ তৈরি হয় সুচিত্রার। বামপন্থার প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। পরবর্তী কালে তাঁকে দেখা যায় গণনাট্য সংঘে, কফি হাউসে বা ধর্মতলায় বামপন্থী শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডায়, এমনকি মিছিলেও। সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে গণনাট্য আন্দোলনের কর্ণধারদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সখ্য তৈরি হয়। পরিচয়ের বৃত্তে আসেন শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখ। 

সুচিত্রা মিত্র মনে করতেন, একজন শিল্পীর শুধু গান গাইলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। যুক্তিসহ সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করাও শিল্পীর কর্তব্য। শিল্পীকে তাই হতে হবে মুক্তমনা, উদার। মিশতে হবে চারপাশের মানুষদের সঙ্গে। কলেজ জীবনে সুচিত্রা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিলেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের অভিযোগে যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের মুক্তির জন্য পতাকা হাতে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করেছেন তিনি। এমনকি টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজেও হার মানতে চাননি। মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ করতে গিয়ে ব্রিটিশ পুলিশদের হাতে মার খেয়েছেন বারবার। 

নিজে মজা করে বলতেন, ‘‘ট্রেনে জন্মেছি তো! তাই সব সময় চলছি। পথ চলাতেই আমার আনন্দ।’’

কি কলকাতায়, কি শান্তিনিকেতনে, শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে সব অসাধ্যই তিনি সাধন করতে পারতেন। ছুটে চলাই যেন তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। অথচ এই মেয়েই গান গাইতে বসতেন গলায় সরস্বতীকে আসন পেতে বসিয়ে রেখে। আজকাল এমন মেরুদন্ড সোজা রাখা শিল্পী কোথায়.....

অমর শিল্পীকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

© অহর্নিশ 
তথ্য : আনন্দবাজার পত্রিকা (আমার মা যে সুচিত্রা মিত্র, সেটা সে দিন বুঝিনি)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ