রাজ্যাভিষেকের সরেজমিন গল্প

• পার্থ মণ্ডল

ঘুরে এলাম ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান থেকে। কন্যার কৃতিত্বে। সত্তর বছর পর বিলেতে আবার বসলো রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান। সময়ের সঙ্গে বহু পরিবর্তনের সাক্ষী ছিল এই অনুষ্ঠান, ডাইভারসিটি আর ইনক্লুসিভনেস এর সুরে বাঁধা ছিল আজকের অনুষ্ঠান। বিবিধের ব্রিটেনে সর্বধর্মের মিলনের সঙ্গীত যেন সবার কানে পৌঁছয় সেই ব্যবস্থার দিকে ছিল কঠোর নজর। সে সব তো খবরের কাগজে আর টিভির পর্দায় চোখ রাখলেই জানা যাবে। বিশদে তাই যাচ্ছি না। চার্লস আর ক্যামিলা দেশের যুবশক্তিকে এই অনুষ্ঠানে শামিল করবার উদ্দেশ্যে আর একটি অভিনব উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁরা পছন্দের নয়টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে বেছে নিয়েছিলেন যাতে সেই সংগঠনগুলির কিছু মনোনীত সদস্য অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত থাকতে পারে। ন্যাশনাল লিটারেসি ট্রাস্ট সেইরকমই একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এটির পেট্রন আবার ক্যামিলা স্বয়ং। আমার কন্যা এই সংস্থার বার্মিংহাম অঞ্চলের ভল্যুন্টিয়ার। মাস দুয়েক আগেই সুসংবাদ পেয়েছিলাম ফোন মারফত যে ওরা বার্মিংহাম থেকে কন্যাকে মনোনীত করেছে অনুষ্ঠানে সশরীরে থাকার জন্য। ব্যক্তি চয়নের ব্যাপারে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গুলি নজর দিয়েছিল মূলত সেই তরুণ তরুণীদের ওপর যারা অল্প সুযোগেই সমাজসেবার ক্ষেত্রে উচ্চমানের কাজ করেছে ও গুরুত্বপূর্ন নেতৃত্ব দিয়েছে। যেহেতু কন্যার বয়স আঠেরোর কম, পেরেন্ট হিসাবে আমারও সুযোগ হলো ওর সঙ্গে থাকার। পিতাপুত্রীর বার্মিংহাম থেকে লন্ডন রাহা খরচ ও লন্ডনে এক রাত্তির থাকার খরচ ট্রাস্টের। সক্কাল ছটায় ঘুম থেকে উঠে সাজুগুজু করে বাপবেটি একসঙ্গে ট্রাস্টের মনোনীত অন্য তিন সদস্যদের সঙ্গে ল্যাম্বেথ প্যালেসে পৌঁছলাম আটটার মধ্যে। এই প্যালেস আসলে হলো আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান পুরোহিত আর্চবিশপ অফ ক্যান্টারবেরির লন্ডন আবাস। এখানেই সমস্ত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চের ব্যবস্থা হয়েছে। ব্রেকফাস্ট শেষে হেঁটে টেমস এর অন্য পারে পার্লামেন্ট হাউসের ভেতর দিয়ে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবির মূল সভাস্থলে পৌঁছতে হলো। সিকিউরিটি ব্যবস্থা চোখে পড়ার মতো, তবে কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবির সেন্ট মার্গারেট'স চ্যর্চ এ ঠাঁই হলো আমাদের, বাকি ভল্যুন্টিয়ারদের সঙ্গে। অনুষ্ঠানের মূলমঞ্চ ছিল চোখের আড়ালে,  তাই আমাদের জন্য ছিল বেশ কিছু জায়ান্ট স্ক্রিন। তবে দৃশ্য চোখের আড়ালে থাকলেও শব্দ ছিল না। স্ক্রিনের ও মূল অনুষ্ঠানের শব্দ ওভারল্যাপ করছিল বেশ। আর তা হয়ে উঠছিল কচিকাঁচাদের মজার উৎস। এমনিতেই ওদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে আর্চবিশপ যখন তাঁর বক্তৃতায় এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির অনুষ্ঠানে উপস্থিতির কথা বললেন। আর যখন আর্চবিশপ ' পরাবো কি পরাবো না ' মন নিয়ে রাজাকে মুকুট পরালেন, তখন কচিকাঁচাদের আনন্দ দেখে কে! অনুষ্ঠানের শেষে রাজা রাণীকে বিদায় জানাতে আমরা চ্যর্চের বাইরে এলাম। স্বর্ণরথে তাঁরা বিদায় নিলে আমরা আবার ল্যাম্বেথ প্যালেসে ফেরত এলাম লাঞ্চের জন্য। সেখানে, কী আশ্চর্য, আজকের অনুষ্ঠানের মূল পুরোহিত অর্থাৎ আর্চবিশপ অফ ক্যান্টারবেরিও আমাদের সঙ্গে স্যান্ডউইচ খেয়ে পিত্তি রক্ষা করলেন। শুধু তাই নয়, হাসি মুখে সেলফি দিলেন আর কন্যার সঙ্গে কথা বললেন।

দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আজ আবহাওয়া ছিল বেশ প্রতিকূল। আবহাওয়া বাগড়া দিলে কন্যার মেজাজ যায় বিগড়ে। তার ওপর রাজতন্ত্র বিরোধী কন্যার মাথায় ঘুরছে, ট্যাক্সপেয়ারের পয়সায় এই মোচ্ছবে যোগ দিয়ে মরালি কি ঠিক কাজ হলো? একদা উপনিবেশবাদী রাজশক্তির এই অনুষ্ঠানে ওর এই যোগদানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতটা কিছুটা হলেও কি শক্ত হলো না? বাংলার সেই কুখ্যাত মন্বন্তরে মৃত দেশবাসীর আত্মার সামনে সে মুখ দেখাবে কী করে? এই সব চিন্তা ভাবনা তার মাথায় ঘুরছে আর মুখ গোমড়া করে বসে আছে। এমনিতেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে ট্রাস্টকে সে তার নাম মনোনীত করার অনুমতি দেয়। তবে মাঝে মধ্যে সেলফি তোলার সময় প্লাস্টিক হাসিটি কিন্তু ঝুলিয়ে দিতে ভোলেনি। আর আমি? পঞ্চাশ পার করেও আমি বিন্দাস। ভারী ভরক্কম চিন্তা ভাবনা মাথায় বিশেষ আসে না। সেই ছোটবেলায় সবকিছুতেই যেমন হাসতাম, আজও হেসেই দিনটা কাটিয়ে দিলাম। শুরু থেকেই ছাই পাঁশ ভাবনা মাথায় আসছিল। ভাবছিলাম, কিছু একটা ঘটুক, যাতে পেটের ভেতরে হাসির থামস আপ বুজকুরি কাটে। কিন্তু তেমন কিছু হলো না, খুব হতাশ লাগছিল। অগত্যা কী ঘটতে পারতো, সেগুলো ভেবে নিজেই হাসলাম। আর কন্যা বললো, তোমার মাথা খারাপ, তুমি ডাক্তার দেখাও। কী ঘটতে পারতো কিন্তু ঘটলো না? যেমন,

১) রাজা রাণী যখন ঘোড়ার গাড়িতে চেপে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে পৌঁছালো তখন যদি পাগলা ঘোড়া ক্ষেপে যেত আর সান্ত্রী বন্দুক ছুঁড়ে মারতো? রথের চাকা ভেঙে চার্লস ভূপাতিত। ক্যামিলা হাত ধরে ওঠানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ। এক সান্ত্রি বললো, উঠুন রাজামশাই, আপনার তো আজ অভিষেক, মোটুক পব্বেন, রাজদণ্ড হাতে উঠবে, রাস্তায় শুয়ে থাকলে চলবে? নিকুচি করেছে তোর মোটুকের, আমার মালাইচাকি খান দু'টুকরো হয়ে গেলো, রাজদণ্ড তোর পেছনে! চার্লস কাতরাতে কাতরাতে বললেন।

২) এর পর চার্লস ভেতরে ঢুকলেন। চেয়ারে বসলেন। অর্চবিশপ একের পর প্রশ্ন ছুঁড়ছেন। কী বে, স্কটল্যান্ড শাসন করবি? ওয়েলস? এই করবি? সেই করবি? সবেতেই আলাদা করে হ্যাঁ হ্যাঁ বলতে বলতে রাজামশাই এর ধৈর্যচ্যুতি হলো। বলে উঠলেন, আরে ধোওওর , তকন থেকে ঘ্যানর ঘ্যানর। বলছি তো হ্যাঁ। এবারে মোটুকটা চাপা দিকি! বাড়ি গিয়ে শান্তিতে একটু বডিটা ফেলতে চাই।

৩) প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে জামাকাপড় ছাড়তে হলো চার্লসকে। ব্যাজার মুখ। আর্চবিশপের হাতে নতুন জামাকাপড়। চার্লস এর মনে হলো সেইই জন্মদিনের সময়ে ফিরে যেতে। সব ছেড়ে আর ছুঁড়ে ফেলে চার্লস দে দৌড়। দুই হাত দেহের দুই দিকে প্রসারিত। প্লেনের মতন একবার ডানদিকে হেলছেন আর একবার বামদিকে। গাইছেন, কোথাও আমার হারিয়ে যাবার ....। এদিকে আর্চবিশপও জামাকাপড় হাতে পেছন পেছন ছুটছেন। রাজামশাই, রাজামশাই আজকের দিনে অন্তত দুষ্টুমি করবেন না....। 

৪) তারপর কোনও ক্রমে চার্লসকে জামাকাপড় পরিয়ে সিংহাসনে বসানো হলো। দুই হাতে রাজদণ্ড আর ভোঁতা তরোয়াল ধরানো হলো। চার্লস এর চোখ দুটো চক চক করে উঠলো। মুখে দুষ্টুমির হাসি। তড়াক করে সিংহাসন থেকে লাফিয়ে একেবারে মাটিতে। বাঁ হাতের দণ্ডটা আর্চবিশপ এর হাতে দিয়ে বললো, এই পুরুত, চ, যুদ্দু যুদ্দু খেলি। তোকে কিন্তু আ আ আ শব্দ করে মরে যেতে হবে। অমনি পুরুত, সরি আর্চবিশপ চোখ পাকিয়ে দণ্ডটা দিয়ে চার্লস এর পিঠে বসালেন এক ঘা, যান! বসুন সিংহাসনে!

৫) চার্লস সুড় সুড় করে সিংহাসনে বসে দুই হাতে দুই দণ্ড ধরলেন। আর্চবিশপ অতিষ্ঠ। এবারে তিনি কোনক্রমে মোটুকটা মাথায় বসাতে পারলে বেঁচে যান। বসালেন ও। চার্লস ও খুব খুশি। প্রথমে মিটি মিটি হাসলেন। এদিকে ক্যামিলা তো গেছে বিগড়ে। সে বলছে আমিও মোটুক পব্ব। পুরুত বলছে একটু সোবুর কর মা। কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। তার এখনই চাই। শেষে সিংহাসন ছেড়ে নেচে নেচে ক্যামিলা গাইতে লাগলো, তোরা যে যা বলিস ভাই....।

৬) সব্বাই আসছে রাজার কাছে। কংগ্রাটস রাজামশাই। বড়ো ছেলে উইলিয়াম ও এলো। বাপের সামনে হাঁটু গেড়ে অনেক কিছু বলে বাপের গালে চুমু খাবার অছিলায় কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো, তুই তো অ্যাদ্দিনে রাজা হলি, আমি কবে হবো রে অ্যাঁ? বলে গালে কামড়ে দিলে! চার্লস ও তার হাতের রাজদণ্ড উইলিয়ামের টাকে ভাঙলো। দুষ্টু ছেলে! হতভাগা! বাপের সঙ্গে ইয়ার্কি! তোরই একদিন কি আমারই একদিন।

৭) এদিকে চার্লস যখন উইলিয়ামকে প্যাদাতে যাচ্ছেন, হয়েছে কী, মোটুকে ছার পোকা ছিল। মানে বাগ। সে ব্যাটারা ঘাড় বেয়ে পিঠে নেমে কামড়াতে আরম্ভ করেছে। রাজামশাই মোটুক ছুঁড়ে রাজদণ্ড দিয়ে পিঠ চুলকাচ্ছেন। আর বলছেন এই ব্যাটা পুরুতটাই যত নষ্টের গোড়া। অ্যাই বিলে (উইলিয়ামের ডাক নাম), ছারপোকা গুলোকে ছাড়বি না। সব কটাকে ধরে পুরুতের বিছানায় ছেড়ে দিয়ে আয়।

৮) এত সব কাণ্ডে রাজামশাই খুব ক্লান্ত। সবাই বললো, রাজামশাই রাজামশাই আপনার ঘুমোবার সময় হয়ে গেছে। বাড়ি যান। রাজামশাই সঙ্গে সঙ্গে লাফাতে লাফাতে সোনার রথে চেপে বসলেন। ক্যামিলার কোলে মাথা রেখে আঙ্গুল চুষতে চুষতে ঘুমিয়ে পড়লেন। রথ চললো প্রাসাদের দিকে। প্রজাদের হর্ষধ্বনি। অশ্বের হ্রেষাধ্বনি। সব একাকার। সবাই বলছে , রাজামশাই রাজামশাই হাতটা নাড়ুন একবার পিলিজ। রাজা তো ঘুমিয়ে কাদা। রাজার বুড়ো আঙ্গুলটা মুখ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রাণী ওঁর হাতটা ধরে নাড়িয়ে দিলেন। ঘুমের মধ্যে রাজামশাই কেঁদে উঠলেন। আর আমি মনে মনে গাইতে লাগলাম, ' হাম্পটি ডাম্পটি স্যাট অন এ ওয়াল। হাম্পটি ডাম্পটি হ্যাড এ গ্রেট ফল। অল দ্যা কিংস হরসেস অ্যান্ড অল দ্যা কিংস মেন, কুডনট পুট হাম্পটি টুগেদার আগেইন ' । ভেবে দেখলাম, ' চিরদিনই তুমি যে আমার ' সুরটা বেশ ভালো খেটে যায়। তাই সেই সুরেই গাইতে থাকলাম।

নাহ, এসব কিছুই হলো না বলেই আফসোস। পরপর দু'দিন বর্তমান কাগজ কন্যার এই কৃতিত্ব কভার করলো। গতকাল ছিল ছবি, আর আজ ওর ছোট্ট সাক্ষাৎকার। তবে দুইদিন দুটো ভুল। ছবির নিচে কন্যার নামের বানান, আর সাক্ষাৎকারে কন্যার বাবার নামের জায়গায় ঠাকুরদার নাম হয়ে গেছে।  

৬ মে ২০২৩
বার্মিংহাম

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ