তেৎসুকো কুরোয়ানাগির ‘তোত্তো-চান’

◾ মধুশ্রী মাহিন্দার

আজ আমার অত্যন্ত প্রিয় বইটি নিয়ে দু-চার কথা লিখতে ইচ্ছে করল। প্রথাগত ধাঁচের বাইরে গিয়ে শিশুরা যাতে খোলামনে স্বাধীনভাবে হাতেকলমে কিছু করার অধিকার পায়, এই উত্তম শিক্ষামাধ্যমের চিন্তাভাবনা মিঃ সোসাকু কোবায়াশির মস্তিষ্কপ্রসূত। রেলগাড়ির বাতিল কামরাগুলোকে স্কুলের ক্লাসরুমের আকার দিয়ে কম সংখ্যক (মাত্র পঞ্চাশজন) ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে খাড়া করলেন আস্ত একটা স্কুলবাড়ি। নাম রাখলেন 'তোমোই গাকুয়েন'। সময়টা ১৯৩৭ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কাল। স্থান জাপানের তোকিও (টোকিও) শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে, জিয়ুগায়োকা স্টেশন থেকে তিন মিনিটের হাঁটা পথের দূরত্বে। 

প্রসিদ্ধ শিশুশিক্ষাবিদ মিঃ কোবায়াশি মানুষের সহজাত গুণের বিকাশে বিশ্বাসী ছিলেন। ব্যাবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার্জন করাকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। একজন সংগীত শিক্ষক হিসাবে বুঝেছিলেন সংগীতের মাধ্যমে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ দ্রুত হয়, তাই তিনি এর উপরে বেশি জোর দিতেন। এই প্রচারবিমুখ মানুষটির ছত্রছায়ায় প্রাকযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও মুক্ত চিন্তার পরিবেশে খুদেরা বড় হয়। এই স্কুলের ছাত্রী তোত্তো-চানের কলমে সর্বকালের সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার অনন্য সাধারণ দিকগুলি উদ্ভাসিত হয়েছে। এমনকি ওই স্কুলের প্রাক্তন-প্রাক্তনীরা আজ নিজ-নিজ স্থানে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। বইয়ের শেষ পৃষ্ঠাগুলিতে তার উল্লেখও আকর হয়ে থাকল।

'জানালায় ছোট্ট মেয়ে'― এই শিরোনাম তেৎসুকোর বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। জাপানি ভাষায় 'জানালায় দাঁড়িয়ে আছে' অর্থ― তাকে সমাজের এক প্রান্তে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, নয়তো একা একা শীতের মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে বোঝায়। ছোট্ট তোত্তো যদিও রাস্তার বাজনদারদের দেখার জন্য নিজের ইচ্ছায় জানলায় গিয়ে দাঁড়াত কিন্তু প্রথম স্কুলে তাকে একলা করে দেওয়ার এই অভিজ্ঞতা দাগ কাটে। একইসঙ্গে ভিন্ন অর্থও খুঁজে পান। জ্ঞানের অন্য জানলা খুলে যাওয়ায় তোমোইয়ের আনন্দমেলায় যোগ দিতে পারেন। যার স্বাদ প্রতিটি ছত্রে ছত্রে আমরা উপভোগ করতে পারছি।

'সাগর থেকে, পাহাড় থেকে' টিফিন আনা ও তার পুষ্টিগত গুণ বুঝিয়ে দেওয়া বেশ মজার। 'ইউরিদমিক্স' খেলার মাধ্যমে ছন্দ ও তাল বুঝে ঐকতান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে শিশুদের মনের মধ্যে কল্পনাশক্তি আর সৃজনশীলতার জন্ম দেওয়া ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে। তোত্তোর সঙ্গে ইয়াসুয়াকির বন্ধুত্বের গল্প পড়তে পড়তে মানবিক মূল্যবোধ শেখায়। যাঁরা বইটি পড়েছেন তাঁরা যে আমার মতো গুলে খেয়েছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিষয় নির্বাচন এত স্বতন্ত্র হওয়ায় বইটি বাচ্চাদের উপহার দিতে পছন্দ করি। নিজেও একাধিকবার পড়েছি। অদৃশ্য চুম্বকীয় শক্তি আছে বোধহয়। বোধহয় কেন, নিশ্চিত। যাঁরা পড়েননি তাঁদের কাছে অনুরোধ অন্তত একবার পড়ুন এবং বাচ্চাদের পড়ান। অত্যন্ত জরুরি একটি বই। চতুর্থ শ্রেণির স্কুলপাঠ্যে যেটুকু স্থান পেয়েছে তা বড়ই অল্প। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো।

সর্বোপরি সাহিত্যপ্রেমী ও বিখ্যাত সংগীতশিল্পী শ্রীমতি মৌসুমী ভৌমিকের বাংলায় এই অনুবাদ নিবিষ্ট মনে পড়তেও চমৎকার। তাঁর আকর্ষণীয় বর্ণনাশৈলীর পাশাপাশি চিত্রশিল্পী চিহিরো ইবাসাকির আঁকা মানানসই ছবিগুলোও নিঃসন্দেহে মন কাড়ে। বয়স অনুযায়ী শিশুদের নানান মেজাজ, হাঁটার ভঙ্গিমা পর্যন্ত তিনি নিখুঁত কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। 

আমার খোলামকুচি জীবনে এটুকু বড় প্রাপ্তি। ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করি। 😊

  • তোত্তো-চান
  • মূল: তেৎসুকো কুরোয়ানাগি
  • অনুবাদ: মৌসুমী ভৌমিক
  • প্রকাশক: ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া
  • মুদ্রিত মূল্য ১০০/-
  • পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৪৯

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ