• তুষার গায়েন
সম্প্রতি 'দেশ' পত্রিকা নজরুল ও জীবনানন্দকে নিয়ে মূল্যায়নধর্মী একটি যুগ্মসংখ্যা প্রকাশ করেছে যা একই মলাটের ভেতর গ্রন্থিত। তাদের এই প্রয়াসকে বাংলাদেশের একটি বিশেষ সাহিত্যিক গোষ্ঠি সন্দেহের চোখে দেখছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে জীবনানন্দ দাশ আধুনিক বাংলাকাব্যের একজন উত্তমর্ণ কবি হলেও, বাঙালির জাতীয় জীবনে সামগ্রিকভাবে কবি হিসেবে নজরুলের যে-প্রভাব, রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অর্থে, তাঁর সাথে কেবল মাত্র রবীন্দ্রনাথের তুলনা হতে পারে। ফলে নজরুল ও জীবনানন্দকে এক মলাটে বন্দি করে অর্ঘ্য প্রদান করার অর্থ নজরুলের মহিমাকে খর্ব করা যা সাম্প্রদায়িক চিন্তা-প্রসূত। এই সন্দেহকে উস্কে দিয়েছে 'দেশ'-এর প্রচ্ছদ, যেখানে জীবনানন্দ উপরে এবং নজরুল নিম্নভাগে স্বাবয়বে উপস্থিত। প্রচ্ছদ নিয়ে সমালোচকদের উপস্থাপিত সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ বিশ্লেষণ ও নাকচ করে আমি আগেই ফেসবুকে একটি লেখা পোস্ট করেছি। এই লেখাটির প্রসঙ্গ হচ্ছে নজরুল ও জীবনানন্দকে একাসনে বসিয়ে অর্ঘ্যপ্রদান করা কি ষড়যন্ত্রমূলক ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রসূত?
এর জবাব দিতে ফিরে যাব প্রায় সিকি শতাব্দী আগে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কবিতায় অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর, কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন (যিনি একাধারে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সম্পাদক) তাঁর পত্রিকা 'একবিংশ'-এ বিশেষ 'জীবনানন্দ-নজরুল সংখ্যা' প্রকাশ করেছিলেন [আগস্ট ২০০০] এবং তাঁর বিখ্যাত সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন :
'নজরুল-জীবনানন্দ' - কেন এই হাইফেনচিহ্নিত যুগ্ময়ন তার ব্যাখ্যা দেয়ার কিছুটা প্রয়োজন হয়ত আছে। গত সংখ্যার সম্পাদকীয়তে যা লিখেছিলাম তা থেকে কিছুটা উদ্ধার করি।
' .... এখানে এটুকু বলে রাখি যে, যাঁরা নজরুলকে পরিত্যাজ্য ভাবেন আমরা তাঁদের দলে নই। নজরুল ইসলাম আমাদের ঐতিহ্যের অংশ, যেমন রবীন্দ্রনাথ, যেমন জীবনানন্দ। জন্মশতবর্ষে জীবনানন্দকে নিয়ে বের হয়েছে, পশ্চিম বাংলায়, অসংখ্য ছোটকাগজের বিশেষ সংখ্যা। নজরুল সেই তুলনায় ব্রাত্য, পরিহৃত ও অস্মৃত। ব্যাপারটিতে শুধু যে তিরিশের আধুনিকতাবাদের অপ্রতিহত জয়োল্লাস আছে তাই নয়, প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতাও রয়েছে বলে ধারণা হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে, সরকারীভাবে নজরুলকে নিয়ে তুলকালাম, কিন্তু মেকি উদ্দীপনা, সেই সাথে জীবনানন্দ সম্পর্কে নিথর শীতলতা ও শৈথিল্য। আমরা মনে করি, নজরুল ও জীবনানন্দ অনেকটা অতুলনীয় (অতুলনাযোগ্য অর্থে) : দুজনের কাব্যভাবনা, কবিতার অন্বিষ্ট সম্পর্কে প্রতীতি, কাব্যভাষা ও শৈলী, অসেতুসম্ভব এক নদীর দুই তীরের মতো। তবু কেউ কারো মহত্ত্বের রাহুগ্রাস নন, দু'জনই স্বরাট -- নজরুল বহুদিন ধরে স্বীকৃত; জীবনানন্দ ইদানীং তাঁর বিরাটত্ব নিয়ে, তাঁর উপন্যাসাবলীর মতোই, ক্রমশ: প্রকাশ্য হচ্ছেন। দু'জনকেই আমরা শ্রদ্ধা নিবেদন করবো, দুই যুগন্ধরকেই অর্পন করবো অঞ্জলি। এতে কোনো কোনো উন্নাসিকের ভুরু যদি কুঁচকে ওঠে, আমাদের কুচ পরোয়া নেই।'
উদ্ধৃতি দীর্ঘ হলো সন্দেহ নেই, কিন্তু আজ থেকে সিকি শতাব্দী আগে কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত একবিংশ-র 'নজরুল-জীবনানন্দ সংখ্যা' পাঠকমহলে দারুণভাবে সমাদৃত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল যুগ্ময়নের যে-প্রচলিত ঐতিহ্য বাঙালি সানন্দে গ্রহণ করে, নজরুল-জীবনানন্দ যুগ্ময়নও প্রত্যাখ্যাত হয়নি সে সময়। কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের মহৎ ও ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। বরং তাঁর পত্রিকার এই বিশেষ সংখ্যায় তরুণ তুর্কীদের লেখা ছাড়াও স্থান পেয়েছিল মোহাম্মদ রফিক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, তপোধীর ভট্টাচার্য, অঞ্জন সেন, ফকরুল আলম, শিশির ভট্টাচার্য্যের মতো প্রতিষ্ঠিত কবি, প্রাবন্ধিক ও লেখকদের লেখা। আজ সিকি শতাব্দী পর কলকাতার 'দেশ' পত্রিকা যদি সেই কাজ করে থাকে, তাহলে সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে কেন? প্রশ্ন উঠতে পারে যদি নজরুলকে নিয়ে পত্রিকায় কোনো অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে। কিন্তু কেউ তো এখনও লেখাগুলো পড়েনি, তাহলে এত 'ইনসিকিরিউটি'র বোধ কেন? বাংলাদেশে নব্বই দশকের পর থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদীদের খুব রমরমা হয়েছে, তাদের আড্ডা-বাচ্চাদের তর্জন-গর্জনে সাহিত্যের পরিবেশ এখন খুব ঘোলাটে, যেকোনো ছুঁতোয় তারা সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্প ছড়াতে থাকে। এসব নিয়ে আমি যতটা না চিন্তিত, তার থেকে বেশি চিন্তিত হয়েছি 'দেশ'-এর এই বিশেষ সংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশের কোনো কোনো প্রবীণ ও শ্রদ্ধাভাজন লেখকের প্রায় একই সুরে অভিযোগ উত্থাপন দেখে ও তাদের লেখায় অনেক বিদ্বান ব্যক্তিদের সমর্থনসূচক মন্তব্য পড়ে। আমার প্রশ্ন এসব প্ৰতিক্ৰিয়া কি সাহিত্য সম্মত, দায়িত্বশীল ও পরিণামদর্শী?
প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন আমি 'দেশ' পত্রিকার লেখক নই, কোনোদিন আমার কোনো লেখা সেখানে ছাপানোর জন্য পাঠাই নি। আমি যা বলেছি তা এই প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে আমার উপলব্ধি মাত্র, এর বেশি কিছু নয়। শান্তি, শান্তি !!
1 মন্তব্যসমূহ
ভাদা
উত্তরমুছুনপ্রাসঙ্গিক ও মার্জিত মন্তব্য করুন