মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা বিতর্ক: একটি সহজ হিসাব


অধ্যাপক ডক্টর রহমতুল্লাহ ইমন

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার অব্যবহিত পরেই বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরের ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সংখ্যাটিকে বলেছিলেন ৩০ লাখ। তিনি মুর্খ, লেখাপড়া জানেন না, চোঙ্গা ফোঁকা মানুষ। ইংরেজি তো জানেনই না। তাঁর কানে কানে কেউ বলেছিল মুক্তিযুদ্ধে ৩ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে। শেখ মুজিবের মত মুর্খ মানুষ লাখের ইংরেজি জানবেন কোত্থেকে? তিনি লাখের ইংরেজি করেন মিলিয়ন আর তাতেই যত গোল- ৩ লাখ হয়ে গেল ৩০ লাখ। গল্প হিসেবে চমৎকার! মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝিতেই যে পাকিস্তানের সবচে বড় মিত্র আমেরিকার পত্র পত্রিকায় ১৫ লাখ মানুষ মারা যাবার কথা ছাপা হল সেই সাংবাদিকেরাও কি ইংরেজি জানতেন না? অস্ট্রেলিয়া ইউরোপের কিছু পত্রিকা এই সংখ্যাটিকে বলেছিল ৪০ লাখ- তারাও ইংরেজি জানত না। বঙ্গবন্ধু এই সংখ্যা উল্লেখ করার সপ্তাহ খানেক আগে প্রাভদায় যে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ বলা হল তারাও কি লাখ আর মিলিয়নের হিসাব বোঝেনি?

আমার অনেক বোদ্ধা বন্ধু এর মাঝেই প্রশ্ন তুলেছেন যে এত বড় একটি ঘটনা নিয়ে কোন গবেষণা হয়নি কেন? এর ওপর শত শত পিএইচডি হবার কথা। একজন পরিসংখ্যানবিদ হয়ে আমরাই বা এতকাল কি ভেরেন্ডা ভাজছি? তাঁদের প্রশ্নের উত্তরে বিনয়ের সাথে বলি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে হাজার হাজার পিএইচডি হওয়া উচিৎ ছিল- হয়নি এটা গর্হিত অন্যায়। একদিন নিশ্চয়ই হবে তা, তবে শহীদের সংখ্যা নির্ধারণের বিষয়টি স্কুলের পাটিগণিতের মত সহজ অংক, পিএইচডি তো দূরের কথা, আমি তো অনার্স ফার্স্ট ইয়ারেও এমন অংক দেবনা। আমরা যখন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র তখনই নির্ভরণ রেখা (Regression Line) এর মাধ্যমে কোন চলকের প্রত্যাশিত মান নির্ণয় করা শিখেছি। এক্ষেত্রে সবচে সহজতম পদ্ধতি হল ক্ষুদ্রতম বর্গ প্রক্রিয়া (Method of Least Squares)। আজকাল স্কুলের ছাত্ররাও জানে কিভাবে এই প্রক্রিয়ার মাধমে সর্বাপেক্ষা মানানসই রেখা (Line of Best Fit) নির্ণয় করা যায় যা সবচে নির্ভুলভাবে প্রত্যাশিত মান নির্ধারণ করে দিতে পারে। নীচের ছবিটি একটু লক্ষ্য করুন। প্রথম ছবিতে ১৯৫০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসংখ্যার গতি প্রকৃতি (Trend) লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখানে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল ১৯৭৫ এ এসে তা আকস্মিকভাবে কমে আসে যে প্রবণতা আরও কয়েক বছর ধরে চলতে থাকে। কালীন সারি বিশ্লেষণে (Time Series Analysis) র পরিভাষায় এ ধরণের প্রবনতাকে ‘ইনোভেশন’ বলা হয়ে থাকে যার অর্থই হল যে ঐ সময়ে কালীন সারিতে কোন অস্বাভিবক ঘটনার উদ্ভব ঘটেছিল। এবার পরের ছবি লক্ষ্য করুন। Line of Best Fit থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রত্যাশিত রেখার ঠিক ওপরে থাকলেও ১৯৭৫ এ তা রেখার বেশ নীচে এবং তা পরবর্তী ১০ বছর আমাদের জনসংখ্যাকে প্রভাবিত করেছে।

এবার আসি ১৯৭৫ এ জনসংখ্যা নির্ধারণের বিষয়টিতে। যে কোন সাধারণ মানের কম্পিউটার প্যাকেজ ব্যবহার করেই একজন স্কুল ছাত্রও দেখতে পাবে যে ক্ষুদ্রতম বর্গ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনুমিত ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত জনসংখ্যা ছিল ৭৮.১৯২৭ মিলিয়ন। যারা এই মানটির যথার্থতা নিয়ে সন্দিহান তাদের জানিয়ে রাখি এক্ষেত্রে R square এর মান ছিল অনেক উচু- ৯৮.৫%। যারা আরও উচ্চমানের পরিসংখ্যান ব্যবহার করতে চান তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি সর্বাধুনিক মজবুত নির্ভরণ (Robust Regression) ব্যবহার করলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৮.১২৫ যেক্ষেত্রে R square এর মান দাঁড়ায় ৯৯.৫%। অথচ ১৯৭৫ এ বাংলাদেশের প্রকৃত জনসংখ্যা কত ছিল জানেন? ৭০.৫৮২ মিলিয়ন। যার সরল অর্থ যা দাঁড়ালো তা হল যদি কম সংখ্যাটিও বিবেচনা করি তবুও প্রকৃত জনসংখ্যা প্রত্যাশিত জনসংখ্যার চেয়ে ৭.৬১০৭ মিলিয়ন কম। তাহলে আমি কি বলব যে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের অনুমিত সংখ্যা আমরা যে বলে আসছি ৩০ লাখ এটা তার থেকেও অনেক বেশি- প্রায় ৭৬ লাখ!

না, আমি সেকথাও বলবনা। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ নানা দুর্যোগ নেমে এসেছিল আমাদের এই বাংলাদেশে। ১৯৭০ এ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে যে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় হয় তাতে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩ থেকে ৫ লাখ। ১৯৭৪ এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা ৩০ হাজার থেকে ১৫ লাখ। যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যাকে ৩ লাখের নিচে নামিয়ে আনতে চান তাদের কাছে বিনীত প্রশ্ন- আপনারা কি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে ৭৪ এর দুর্ভিক্ষে মুক্তিযুদ্ধের তুলনায় ৫ গুণ বেশি লোক মারা গিয়েছিল? আর ইউ কিডিং???

এবার ৭৬ থেকে হাই এস্টিমেট ২০ আর নিহত রাজাকার আলবদর সহ অন্যান্য অপশক্তির সর্বোচ্চ সংখ্যা বাদ দিলেও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের আনুমানিক সংখ্যা দাঁড়ায় অন্তত ৫৫ লাখ। হ্যাঁ, ভুল শোনেননি- ৫৫ লাখ। কিভাবে? আমরা যে ৩০ লাখ শহীদের কথা বলি তাঁরা শহীদ হয়েছেন আমাদের দেশের মাটিতে। কিন্তু যে এক কোটিরও বেশি মানুষ ভারতে শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের মধ্যে ৫-১০ লাখ মানুষ মৃত্যু বরণ করেছিলেন। লাখের ওপরে মানুষ মারা গেছে যাত্রা পথেই। আর যে কোন দুর্ঘটনায় প্রাথমিক তথ্য উপাত্ততে প্রাণহানির যে সংখ্যা পাওয়া যায় সময়ের সাথে সাথে তা বাড়ে- কমে না। আমরা সবাই জানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের হাতে নিহত ইহুদিদের সংখ্যা ৬ মিলিয়ন। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে পূর্ব ইউরোপ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে যে নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে অনেক বেশি- এটা প্রায় ১০ মিলিয়ন হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের এই বাংলাদেশে এবং ভারতীয় শরনার্থী শিবিরে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা ৫৫ লাখ হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ