গান যেভাবে সর্বজনের স্লোগান হয়ে উঠেছিলো

ফুলবাড়ী দিবস

▇  আহমেদ মওদুদ

২৬ আগষ্ট ২০০৬ খ্রীষ্টাব্দ। দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার নিমতলী মোড়কে কেন্দ্রে রেখে পার্শ্ববর্তী রাস্তার প্রায় দেড় থেকে দুই কিলোমিটার জুড়ে কেবলই মানুষের ঢল। প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার মতান্তরে ১ লাখেরও অধিক মানুষের কুলকিনারাহীন মিছিল। মানুষের সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও মিছিলের উদ্দেশ্য নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। উদ্দেশ্য একটাই, ‘একদফা এক দাবী, এশিয়া এনার্জি তুই আজই যাবি’। অর্থাৎ আধিপত্যবাদী লুটেরা বেনিয়া কোম্পানী এশিয়া এনার্জির অফিস ঘেরাও করে কয়লা সম্পদে সমৃদ্ধ ফুলবাড়ি ও পার্শ্ববর্তী তিন উপজেলা তথা বিরামপুর, পার্বতীপুর, নবাবগঞ্জ তথা দিনাজপুর জেলা তথা বাংলাদেশ থেকে তাদেরকে তাড়ানো। তাড়ানোর জন্য জমায়েত হওয়া দীর্ঘদেহী যে মিছিল তার অগ্রভাগে ছিল ট্রাকের তৈরী চলমান মঞ্চ যেখানে থেকে একের পর এক বক্তব্য রেখে যাচ্ছিলেন তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির জাতীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং একই মঞ্চ থেকে বক্তব্যের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ট্রাকে অবস্থান করা শিল্পীগণ গান পরিবেশন করছিলেন। ঘেরাও দিবসে মাস  ছয়েক আগে ফুলবাড়ির কয়লাখনিকে উপজীব্য করে নিজের লেখা ও সুর করা একটি গণ-গানের কল্যাণে সেদিনের সেই ভ্রাম্যমান মঞ্চে থাকা হয়েছিল। ‘কয়লা নিয়ে পালাচ্ছে কে ধর’ শিরোনামের গানটির জন্ম নিয়ে কথা বলতে গেলে আগেই যেটা বলেছি ২০০৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৬ আগষ্ট থেকে কমপক্ষে ৬ মাস আগে ফিরে যেতে হয়। তবে তারও আগে আমাদেরকে ফিরে যেতে হয় বাংলাদেশে এশিয়া এনার্জির উত্থান, এশিয়া এনার্জির সাথে তৎকালীন (বিএনপি) সরকারের শিশুতোষ/ ভুঁইফোড়/ আনাড়ি/ গাঁজাখোরি/ বালখিল্য চুক্তির ঘটনা বাহুল অতীতের দিকে। এ বিষয়ে আমরা বরং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক, লেখক এবং তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির তৎকালীন সদস্য সচিব, মহাত্মা আনু মুহাম্মদের স্মরণাপন্ন হই। মহাত্মা  আনু মুহাম্মাদ আমাদের জানাচ্ছেন, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়লা কোম্পানী অস্ট্রেলিয়ার বিএইচপি’র সাথে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার অর্থাৎ বিএনপি সরকার দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে কয়লা সম্পদ  অনুসন্ধ্যানের লাইসেন্স সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯৯৪ সালের ২০ আগষ্ট। অনুসন্ধ্যানে বিএইচপি ফুলবাড়ীতে সমৃদ্ধ কয়লাখনির অস্তিত্ব সর্ম্পকে নিশ্চিত হয়। পরবতী  (আওয়ামীলীগ) সরকারের আমলে হঠাৎ করে এশিয়া এনার্জি নামের কোস্পানিটির জন্ম  হয়। বিএইচপি অনভিজ্ঞ এই কোম্পানিটির হাতে নিজেদের লাইসেন্স হস্তান্তর করে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। অর্থ্যাৎ একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের একজন হাতুড়ে ডাক্তারের হাতে ফোঁড়া কাটার দায়িত্ব তুলে দেওয়ার মত ঘটনা বলা যায়। তো মহাত্মা আনু মুহাম্মদ আমাদের জানাচ্ছেন, কয়লা উত্তোলনের দুইটি পদ্ধতি যথা (১) উন্মুক্ত পদ্ধতি (২) সুড়ঙ্গ পদ্ধতির মধ্যে উন্মুক্ত খনি পদ্ধতিটি লাভজনক জেনেও বিএইচপি ফুলবাড়ী কয়লাখনি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিল! আনু মুহাম্মদের ভাষ্যে, বিএইচপির কনসালট্যান্ট জিওলজিষ্ট হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করা অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী ভূ-তত্ত্ববিদ নজরুল ইসলাম তাঁকে জানান, উন্মুক্ত খনি বিএইচপি’র জন্য নিশ্চয় অনেক লাভজনক হতো কিন্তু তার জন্য যে গভীরতায় কয়লাস্তর থাকা দরকার ফুলবাড়ীর কয়লা তার চেয়ে ১৫০ থেকে ২৬০ মিটার গভীরে। বিএইচপি জানতো,এরকম গভীরতায় উন্মুক্ত খনি করতে গেলে ভূ-তাত্ত্বিক ও কারিগরি সমস্যা মোকাবেলা করার পাশাপাশি বহুমাত্রিক দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করে তবেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের বন্যাপ্রবণ ওই অঞ্চলে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি করতে গেলে উত্তরাঞ্চল সহ পুরো বাংলাদেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে এবং যার দায় আবার বিএইচপি’র কাঁধেই বর্তাবে। ফলে বিএইচপিকে বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণ পরিশোধের সম্ভাবনাসহ ফিরে যেতে হবে জন্য তারা আগেভাগেই বাংলাদেশ ত্যাগ করে।
ফুলবাড়ী, ২৫ আগস্ট ২০২২ (ছবিতে লেখক, আনু মুহাম্মদ ও নূরে আজম দিপু।) ছবি: আনহা এফ খান

বিএইচপি’র মতো একটা অভিজ্ঞ কোম্পানি যেখানে কোম্পানীর জন্য অপেক্ষাকৃত লাভজনক উন্মুক্ত খনি  পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সাহস দেখায়নি সেখানে এশিয়া এনার্জির মতো হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটা কাগুজে কোম্পানী  যখন কয়লা উত্তোলনের জন্য উঠে পড়ে লাগে, কয়লা উত্তোলনের লাইসেন্স পেয়ে যায়, পরিবেশগত সমীক্ষা করার আগেই পরিবেশ ছাড়পত্র পেয়ে যায় তখন তারা স্বাভাবিক ভাবেই তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সন্দেহের পাত্রে পরিণত হয়। প্রকল্পের শুরুতেই নানা মাত্রার দূর্নীতির আভাস পেয়েই মূলত গবেষণায় নেমে পড়ে জাতীয় কমিটি। কমিটির গবেষণায় উঠে আসেঃ
 
  • (১) বিএইচপি’র সাথে চুক্তির সময় রয়্যালিটি ছিল ২০ শতাংশ অথচ এশিয়া এনার্জির সাথে সেটা ৬ শতাংশে নেমে আসে।
  • (২) বিএইচপি’র এশিয়া এনার্জিকে প্রকল্পের দায়িত্ব হস্তান্তরের বৈধ কোন কাজপত্র নেই।
  • (৩) প্রকল্পের কাজ শুরু করার আগে এশিয়া এনার্জি বাংলাদেশ সরকারকে ৩ শতাংশ ব্যাংক গ্যারান্টি জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেয়নি। ফলে তাদের যেকোন ধরনের দলিল-পত্রের পুরোটাই অবৈধ।
  • (৪)  আইন অনুযায়ী উন্মুক্ত খনির জন্য যে পরিমাণ জমি দেওয়ার  কথা তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি জমি দেওয়া হয় এশিয়া এনার্জিকে।
  • (৫) নিয়মানুযায়ী, খনির কাজ শুরু করার আগে খনি এলাকার জনগনের সম্মতি নিতে হয় অথচ এই প্রকল্প সম্পূর্ণভাবে আদিবাসী অধ্যুষিত ওই এলাকার মানুষের বিপক্ষে দাঁড় করানো হয়।
  • (৬) এশিয়া এনার্জি নিজেদের অপর্কম ঢাকার স্বার্থে প্রকল্প এলাকায় দালাল, সন্ত্রাসী সৃষ্টি করে, ইনফরমার নিয়োগ করে। এছাড়া বিনিয়োগের অংশ হিসেবে প্রকল্প এলাকার জনগণের মধ্যে ঘুষ হিসেবে রঙ্গিন টিভি, ফ্রিজ সহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী বিতরণের চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
  • (৭) চূড়ান্ত ওয়ার্ক অর্ডার পাওয়ার আগেই এশিয়া এনার্জি ফুলবাড়ি প্রকল্প দেখিয়ে শেয়ার বাজারে প্রতারণা করে, লন্ডন শেয়ার মার্কেট তার শেয়ারের দর বাড়ায়, পুঁজি বাজার থেকে সংগ্রহ করে পুঁজি।
 

ফুলবাড়ী আন্দোলনের ছবি
ফুলবাড়ী আন্দোলনের ছবি

চিহ্নিত এইসব অনিয়মের আড়ালে ক্রমেই আরো যেসব অনাচার উজ্জ্বল হয়ে উঠতেছিল তার মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়া, হাজার হাজার একর তিন ফসলি জমি চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া, দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গিয়ে মরুময়তা দেখা দেওয়া, খাদ্য-নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়াসহ দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান অসংখ্য ক্ষয়-ক্ষতি। জরিপে দেখা যায় ৪০ বছরে ৬ শতাংশ রয়্যালিটি থেকে প্রাপ্ত আয় অপেক্ষা ওই অঞ্চলের কৃষি ও অন্যান্য খাত থেকে প্রাপ্ত আয় অনেক বেশি। অর্থাৎ খনি না করেই দিনাজপুর জাতীয় অর্থনীতিতে যা যোগান  দিচ্ছে, খনি থেকে তা সম্ভবতো হচ্ছেই না বরং নানা মাত্রার বিপদ আমদানি করা হচ্ছে কেবল। অর্থাৎ খাল কেটে কুমির আনাই যেন মূল কাজ। তো মূলের কাজে কান্ডের বাধা শুরু হয়ে যায় এরপরই। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ‘ফুলবাড়ী শহর রক্ষা কমিটি’র ব্যানারে সর্বপ্রথম খনির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। এরপর আন্দোলনের পরিধি বৃদ্ধির লক্ষ্যে কমিটিতে শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষকে যুক্ত করে ‘ফুলবাড়ী রক্ষা কমিটি’র ব্যানারে খনি এলাকার চার উপজেলার মানুষ মিছিল নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেয়। ২০০৫ সালের জুলাই মাসে ‘ফুলবাড়ী রক্ষা কমিটি’ জাতীয় কামিটির সাথে যোগাযোগ করলে জাতীয় কমিটি ফুলবাড়ীর নেতৃবৃন্দের সাথে এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে একযোগে আন্দোলন করার বিষয়ে একমত হয়। মূলত এর পরেই দেশব্যাপী আন্দোলনের ডালপালা গজাতে শুরু করে। যার ধারাবাহিকতায় রংপুরেও শুরু হয় খনি বিরোধী প্রচারণা। রংপুরে আন্দোলনকে বৃহৎ পরিসরে নিয়ে যেতে বিজ্ঞান চেতনা পরিষদের নাহিদ হাসান, দীপালী রায়, হেমন্ত রায় হিম, সাংস্কৃতিকর্মী  নূর-এ-আজম দীপু, ছাত্র ফেডারেশনের দীপক কুমার  রায়, কর্নেল তাহের পরিষদের সংগঠক প্রয়াত লেখক সেতু আশরাফুল হক, দর্শনের শিক্ষক চিনু কবির, আখতার ফারুক, সংস্কৃতিকর্মী মুকুল শিকদার, মারুফা জাহান  চম্পা, বিপ্লব হোসেন প্রমুখ গড়ে তোলেন ‘উত্তরাঞ্চল বাঁচাও আন্দোলন’ নামের একটি প্লাটফর্ম। কবিতাকর্মী হিসেবে আমিও যুক্ত হয়ে পড়ি কমিটিবিহীন এই প্লাটফর্মে। বিজ্ঞান চেতনা  পরিষদের কোন এক পাঠচক্রে সংস্কৃতির নয়া সেতুর সংগঠক মঞ্জুরুল আহসান এই প্লাটফর্মের নামকরণ করেন। তিনি ‘উত্তরবঙ্গ বাঁচাও আন্দোলন’ নামটি প্রস্তাব করলেও সর্বসম্মতিক্রমে ‘উত্তরাঞ্চল বাঁচাও আন্দোলন’ নামটি  চূড়ান্ত হয়। মূলত জাতীয় কমিটির সহযোগী সংগঠন হিসেবে কাজ করে এই প্লাটফর্ম। এই প্লাটফর্ম থেকে এশিয়া এনার্জির বিপক্ষে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে রংপুর শহরের অলি-গলি দিনরাত চষে বেড়াই আমরা। কাল একখানে মিটিং তো পরশু আরেকখানে। সেসব মিছিল-মিটিং এ মাঝে-মধ্যে এসে যোগ  দেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কুড়িগ্রাম জেলা সংসদের সংগঠক সাজেদুল ইসলাম সাজু। প্রায়ই দেখা যেত ফুলবাড়ী থেকে রংপুরে এসে ‘উত্তরাঞ্চল বাঁচাও আন্দোলন’-এর কর্মীদের সাথে বৈঠক করতেন কয়লা আন্দোলনের সংগঠক সঞ্জিত প্রসাদ জিতু, শাহরিয়ার সানি এবং সোহেল কবির। এসেছিলেন গানের দল ‘বির্বতন’-এর মণীষা। রংপুর টাউন হলে নূর-এ-আযম দীপুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা। সভায় জাতীয় কমিটির নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি ফুলবাড়ির নেতৃবৃন্দও বক্তব্য রাখেন। আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রচুর লোক-সমাবেশ হয়। আলোচনা শেষে গান পরিবেশন করেন গণ-মানুষের শিল্পী কফিল আহমেদ এবং গানের দল ‘চিৎকার’র পদ্ম। ঐদিন আলোচনা অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পূর্বে টাউন হলের মাঠে  কফিল ভাইয়ের সাথে আমাদের দীর্ঘ আড্ডা হয়। সেখানে কফিল ভাই তার জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা শোনান আমাদেরকে, আমি শোনাই আমাদের বন্ধু কবি ফিরোজ এহ্তেশমের লেখা এবং আমার লেখা গান। অর্থাৎ গানে-গল্পে-দ্রোহে আমরা তখন একাকার।
ফুলবাড়ী আন্দোলনের প্রতিবাদী ছবি
ফুলবাড়ী আন্দোলনের প্রতিবাদী ছবি

আমি তখন পার্কের মোড়ে ‘বেলী ম্যানসন’ নামের একটা মেসে থাকি। মাষ্টার্সের ফলাফল প্রকাশ হয়নি সম্ভবত। পার্কের মোড়ের পাশেই ‘রংপুর প্রিক্যাডেট’ নামে শিশুদের একটা স্কুলে ৮টা- ১০:৩০টা পর্যন্ত পড়াই আর বাকী সময় কবিতা-গল্প-গান-আড্ডা-আন্দোলন করে বেড়াই। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান বিপ্লব একদিকে ছিলেন সংস্কৃতিমনা মানুষ অন্যদিকে বড় ভাইয়ের বন্ধু। ফলে তার কাছে পাই  প্রচুর আস্কারা আর স্কুল ফাঁকির হাতছানি। তখন মেসে এবং স্কুলে নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল দীপক রায় ও নাহিদ হাসানের (এর বাইরে মেসে যাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল তাদের কথা গোপন থাকুক) এবং আমারও নিয়মিত যাতায়াত ছিল কেডিসি রোডের দীপক রায়ের মেসে এবং লালবাগে নাহিদ হাসানের মেসে। ফুলবাড়ীর কয়লাখনির প্রকৃত তথ্য মিডিয়াকে জানাতে এবং মিডিয়াকে ফুলবাড়ীর পক্ষে কাজ করার অনুরোধ নিয়ে একবার আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। চার সদস্যের সেই দলের মধ্যে ছিলেন নাহিদ হাসান, নুুর-এ-আজম দীপু, মারফা জাহান চম্পা এবং আমি। প্রথম দিন আমরা ‘প্রথম আলো’র অফিসে যাই। আমি তখন ‘প্রথম আলো’র সাহিত্য সাময়িকীর নিয়মিত লেখক। প্রথমে আমরা দেখা করি  আনিসুল হকের সাথে। এছাড়া সাজ্জাদ শরীফের সাথেও আমাদের কথা হয়। তবে আলোচনায় আমরা খুব একটা আশাবাদী হতে পারিনি। তখন আমাদের মাথায় ফুলবাড়ীর বিপ্লব আর তাদের মাথায় বাংলা বানান বিষয়ে বিপ্লব ঘটানোর চিন্তা। বের হওয়ার সময় আমি সাময়িকীর ডেস্কে গিয়ে জাফর আহমদ রাশেদের সাথে দেখা করে হাই-হ্যালো করি। পাশাপাশি তাকে এটাও বলতে ভুলিনি যে ফুলবাড়ীর কাজেই মূলত প্রথম আলোর অফিসে আসা। তো এই রকম নানা মাত্রার ভ্রমণ আর কবিতা-গল্প-গান-দ্রোহ এবং কেজো আড্ডার আবহে দিনগুলো চলে যাচ্ছিল। এ সময় দৈনিক ‘প্রথম আলো’ এশিয়া এনার্জির প্রচারণামূলক বিজ্ঞাপন, কোম্পানির স্বপক্ষে কলাম ইত্যাদি  প্রকাশ করলে এর প্রতিবাদস্বরূপ নাহিদ হাসান আমাদের উপস্থিতিতে রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় আগুন দেয়।

উত্তরবঙ্গ বাঁচাও আন্দোলনের লিফলেট
উত্তরবঙ্গ বাঁচাও আন্দোলনের লিফলেট

যতদূর মনে পড়ে, সেদিন সম্ভবত শুক্রবার ছিল। সকাল এগারোটার দিকে টাউন হল চত্ত্বরের সরকারী গণ-গ্রন্থাগারের সিঁড়িতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা। নাহিদ হাসান গ্রন্থাগারের দেয়ালে ইটের টুকরো দিয়ে ফুলবাড়ীর কয়লা-খনির লাভ-ক্ষতির হিসেব কষছিলেন। দীপু ভাই অনুরোধের সুরে বললেন, মওদুদ, একটা গান লেখেন না কয়লা খনি নিয়ে। দীপু ভাই সাধারণত হাস্যরসের মাধ্যমেই বেশিরভাগ সিরিয়াস কথাবার্তা বলে থাকেন। কিন্তু গান লেখার কথা বলার সময় তাকে আমার শতভাগ সিরিয়াসই মনে হলো। তো প্রেম আর দ্রোহের সেই মৌসুমে দীপু ভাইয়ের কথাটা কবুল করে ফেলি। সেদিন সিঁড়িতে বসেই কয়লা খনি নিয়ে একটা গান লিখে ফেলি এবং সুরও করি তাৎক্ষনিক। স্মৃতি বিভ্রাট না ঘটলে সিঁড়ির সেই আড্ডায় চিনু কবির, আখতার ফারুক, দীপক রায়, হিম রায়, তৌহিদুর রহমান প্রমুখের থাকার কথা। থাকার কথা বলছি এই জন্য যে, টাউন হলের আড্ডা মানেই আমাদের এই সার্কেলটার উপস্থিতি ছিল অবসম্ভাবী। একটা সময় কেবলমাত্র আন্দোলনের কারনেই আমরা টাউন হলের কারো কারো মাথা-ব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পেরেছিলাম। একদিন সন্ধ্যার সময় টাউন হলের গোল চত্বরে (পরে যা সাহিত্যমঞ্চ হিসাবে পরিচিতি পায়) বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, সাথে আর কে বা কারা ছিল ঠিক মনে নেই (২০২২ সালে এসে ২০০৬ সালের ইতিহাস লিখতে গেলে যা হয় আরকি)। হঠাৎ শুনলাম টাউন হলের গা ঘেঁষে বেশ হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটি বহূল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকার রংপুর প্রতিনিধি নাহিদ হাসানকে বেশ বকাঝকা করছেন। আমাকে দেখে ভদ্রলোক খানিকটা শান্ত হলেন বটে তবে বললেন, তোমাদের আসকারা পেয়েই টাউন হলে এদের এত বাড় বেড়েছে। মনে মনে বললাম, বাড়ুক তবে। এমন অনেক রাত গেছে চা-সিগারেট খেয়ে পকেটের সর্বস্ব খুইয়েছি, রিক্সা ভাড়াও নেই। এরপর কফিল আহমেদ আর আমার কয়লার গান গাইতে গাইতে আমি দীপক রায় আর নাহিদ হাসান টাউন হল থেকে হেঁটে লালবাগে, পার্কের মোড়ের  মেসে পৌঁছেছি মাঝরাতে। বিশেষ করে শাপলা চত্বর থেকে লালবাগ মোড় পর্যন্ত রাস্তার দুধারে যে বাড়ি ওয়ালারা ছিল তারা সম্ভবত আমাদের গান শুনে রাতের সময়ের ধারনাটা পেয়ে যেতেন। আমরা পেয়ে যেতাম হেঁটে হেঁটে মেসে পৌঁছানোর অনুপ্রেরণা। পরের সকাল হয়তো আমাদের জন্য আন্দোলনের নতুন কোন কর্মসূচী নিয়ে অপেক্ষা করছে। মূলত এভাবেই ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে ২৬ আগষ্ট ২০০৬ খ্রীঃ, এশিয়া এনার্জির অফিস ঘেরাও কর্মসূচীর মহেন্দ্রক্ষণ। ২৬ আগষ্ট ভোরে আমরা রংপুর ষ্টেশন থেকে ট্রেনে পার্বতীপুর পর্যন্ত যাই এরপর সেখান থেকে ফুলবাড়ীর ট্রেনে উঠি। আমরা বলতে ছাত্র ফেডারেশনের রংপুর জেলার তৎকালীন সংগঠক তৌহিদুর রহমান, দীপক কুমার রায় এবং মারুফা জাহান চম্পা প্রমূ। আখতার ফারুক তার কলেজ এলাকা বদরগঞ্জ থেকে সিপিবি'র (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি) আন্দোলনকারীদের সাথে ট্রাক্টরে করে ফুলবাড়ী পৌঁছান। তার কাছে ছিল বেশ কিছু পাকা আম। সেই আম সেদিন আমাদের ক্ষুধা নিবারণে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। সেতু আশরাফুল হক এবং জাহিদা পারভিন জুটিও পৃথকভাবে ফুলবাড়িতে পৌঁছান। হিম রায়, দিপালী রায় সহ অন্যরা কয়েকদিন আগে থেকেই ফুলবাড়ীতে অবস্থান করে স্থানীয় এবং জাতীয় কমিটির সাথে একযোগে কাজ করে যাচ্ছিলেন। তবে ২৬ আগষ্ট নাহিদ হাসান ফুলবাড়ীতে উপস্থিত ছিলেন না। ছিলেন কুড়িগ্রামে। যাই হোক আমাদের সাথে বিডিআরের বিশাল এক বহর একযোগে ট্রেনের যাত্রী হয়েছিলেন এবং তাদের সাথে আলাপে বুঝা গেলো তারও ফুলবাড়ীতে যাচ্ছেন এবং আমাদের মত তারাও কয়লা-খনির উদ্দেশেই। তবে তারা যাচ্ছেন সরকারের পক্ষ থেকে এশিয়া এনার্জির স্বপক্ষে। এরপর তাদের সাথে কথা খুব বেশি একটা এগোয়নি আমাদের। তো সকাল ১০:৩০ থেকে ১১ টার মধ্যে আমরা ফুলবাড়ী স্টেশনে গিয়ে নামি এবং সেখান থেকে রিক্সায় নিমতলা মোড়ে পৌঁছি। ততক্ষণে নিমতলা মোড় জমে উঠেছে। বক্তারা বক্তব্য দিতে শুরু করে দিয়েছে, গানের দল গান গাইতে শুরু করে দিয়েছে আর চর্তুদিক থেকে মুহুর্মুহু মিছিল আসতে শুরু করে দিয়েছে। এমতাবস্থায় তৌহিদুর রহমান সমগীতের অমল আকাশের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে, কয়লা নিয়ে মওদুদের লেখা ও সুর করা একটা গান আছে, গানটা তুলে নেন। অমল আকাশ দলের অন্যদের সঙ্গে নিয়ে, আমাকে নিয়ে একটা হোটেলে বসে চা-সিঙ্গারা খেতে খেতে গানের সুরটা তুলে নিলেন। আমাকেও তারা তুলে নিলেন ট্রাকে, তাদের সাথে গান গাওয়ার জন্য। তৌহিদও সেদিন আমাদের সাথে কন্ঠ মিলিয়েছিল। গানের লিরিক ছিল:
 
 
    কয়লা নিয়ে পালাচ্ছে কে ধর
    ধর  ধর  ধর  ধর
    ময়লাতে আজ যাচ্ছে ভরে ঘর
    ধর  ধর  ধর  ধর (২)
       
    ফুলবাড়ী তোর আর কোন ফুল চুরি হতে দেবনা
    কয়লা দিয়ে বিদেশীদের ময়লা আমরা নেবনা
    ফুল কিংবা কয়লা কিছুই চুরি হতে দেবনা।
       
    ফুল ছিড়ে আর ভুলের মাশুল দেবনা
    কাঁটা দেব কৃষ্ণকলি দেবনা
    ভিনদেশীদের বিষের ভাড়ার মুখে তুলে নেবনা।
       
    যা ফিরে যা রক্ত চোষা শ্বেতপোলা
    বাঙালিরা নয়রে এখন মনভোলা
    দেখ্ চেয়ে দেখ্ লাঠিয়ালের চোখ খোলা।


গানটা ঘেরাও দিবসের ৫/৬মাস আগে লেখা হলেও মিছিল জুড়ে যেন গানের শেষ লাইনটারই দৃশ্যায়ন। অর্থাৎ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মিছিলের সবার হাতেই কমবেশী লাঠি ছিল। এছাড়া মিছিলের  অগ্রভাগে থাকা আদিবাসী জনগোষ্টির হাতে শোভা পাচ্ছিল তাক করা তীর-ধনুক। তো ট্রাকে বসেই শিল্পীরা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সাঁওতাল বিদ্রোহের গান ‘হুর তাং তাং’- এর প্যারোডি বানিয়ে গাচ্ছিলেন। আমিও কণ্ঠ মেলাই শিল্পীদের সাথে। এছাড়া সেদিন গেয়েছিলাম স্থানীয় শিল্পীদের গাওয়া কিছু গানও। মহাত্মা আনু মুহাম্মদ স্থানীয় ভাবে যে সব শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক দল শুরু থেকেই গান দিয়ে খনি এলাকার মানুষের মধ্যে জাগরণের কাজটি করেছেন তাদের বিষয়ে জাতীয় কমিটির মুখপত্র ‘সর্বজন কথা’য় বিস্তারিত লিখেছেন। লিখেছেন ঢাকা থেকে আসা গানের দল এবং শিল্পীদের বিষয়েও। এছাড়া তিনি আমার লেখা গানটির কথাও  বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, শিল্পী অমল আকাশ ‘সর্বজন কথা’র একই সংখ্যায় তার লেখায় আমার গানের কথা উল্লেখ করলেও গীতিকারের নাম বেমালুম ভুলে গেলেন! অবশ্য পরবর্তীতে এ বিষয়ে আমি ফেসবুকে লেখলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে পরবর্তীতে সংশোধন করে দিবেন বলে জানান। তবে পরবর্তীতে তার সেই সংশোধনী সম্পর্কে আমার আর কিছুই জানা হয়নি যদিও।

ফুলবাড়ী আন্দোলনের বিজয় মিছিল করছে শিশুরা
ফুলবাড়ী আন্দোলনের বিজয় মিছিল করছে শিশুরা

চলছে গান, চলছে বক্তব্য আর সমতালে চলছে গাড়ি গাড়ি আর্মি-পুলিশ-বিডিআরের মহড়া। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি তাদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের আবহ তৈরি হয়ে গেল যেন! দুপুর ১২টার পর জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে সত্তর থেকে আশি হাজার মতান্তরে এক লাখ মানুষের মিছিল নিমতলা মোড় থেকে যমুনা ব্রিজের দিকে রওয়ানা হয়। ব্রিজের ওপারেই এশিয়া এনার্জির অফিস। গানের দলে ছিলাম যারা তারা কিছুক্ষণ ট্রাকে করে আবার কিছুক্ষণ পায়ে হেঁটে এগুচ্ছিলাম নেতাদের পাশাপাশি। মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন- প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আনু মুহাম্মদ, টিপু বিশ্বাস, বিমল বিশ্বাস, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, জোনায়েদ সাকী, হায়দার আকবর খান রনো, সৈয়দ আবুল মকসুদ, সাইফুল ইসলাম জুয়েল, আমিনুল ইসলাম বাবলু প্রমুখ। এছাড়াও সারা দেশ থেকে আসা রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মীদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। নিমতলা মোড় থেকে ঢাকা মোড় হয়ে দুপুর ২ টার দিকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরের ছোট যমুনা সেতুর সামনে পৌঁছাই। ততক্ষণে পুলিশ-বিডিআর সেতুতে ব্যারিকেড দিয়ে দেয়। আমাদের মিছিল আর সেতু পার হতে পারেনা। আনু মুহাম্মদ তাৎক্ষনিক ভাবেই একটা রিক্সাভ্যানের উপর দাঁড়িয়ে এশিয়া এনার্জির বিপক্ষে জনগণের রায় পড়ে শোনান। রায় থেকে এশিয়া এনার্জিকে বাংলাদেশে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয় এবং সেদিন বিকেলের মধ্যে তাদেরকে ফুলবাড়ী ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেতৃবৃন্দকে জানানো হয় যে, এশিয়া এনার্জি দ্রুতই ফুলবাড়ী ত্যাগ করবে। এই প্রতিশ্রতির পর জাতীয় কমিটির সভাপতি মহাত্মা শেখ মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ সমাবেশের সমাপনী ঘোষনা করেন। ফলে মিছিলের গতিমুখ পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ মিছিলটি ঘুরে গেলে আমরা যারা মিছিলের শুরুতে ছিলাম তারা শেষাংশ হিসেবে পরিগনিত হই। তো ব্রিজের মুখ থেকে মিছিল আনুমানিক ৫০ গজ সরে আসতেই পুলিশ শান্তিপূর্ন সমাবেশে হঠাৎ করেই কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে। আমরা হতভম্ভ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়ে পুনরায় প্রতিরোধ গড়ে তুলি। ততক্ষনে মিছিলের  মূল স্রোত অনেকদূরে চলে যায়। ঘটনা স্থলে কেবল মাত্র শখানেক মানুষ ইট- সুরকি দিয়ে ব্রিজের ওপরে ও সামনে থাকা পুলিশের মোকাবেলা করে যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষন পর খেয়াল করলাম আমার আশে-পাশে পরিচিত কেউ নেই। যারা আছে তাদেরকে ফুলবাড়ীর স্থানীয় মানুষ বলেই মনে হলো। তথাপি তাদের সাথে তাল মিলিয়ে পুলিশ-বিডিআরের দিকে ইটের টুকরা ছুড়ে মারছিলাম। ক্ষোভ একটাই তারা আমাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে টিয়ারসেল ছুড়ে মেরেছে! এর মধ্যে তৌহিদ গিয়ে আমাকে টেনে আনার চেষ্টা করলো। বললো, পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধের না। কিন্তু আমি আসছিলাম না কোন মতেই। এরপর দীপক রায়ও আমার কাছে চলে এলো এবং বলা চলে তারা দু'জন আমার দুই বাহু ধরে একরকম টেনে-হিঁচড়ে সেখান থেকে নিয়ে এলো। ঘটনাস্থল থেকে একটা ছোট সড়কের ১০ থেকে ১৫ ফিট ভিতরে ঢুকতেই খেয়াল করলাম গাছের ডাল থেকে কা কা করতে  করতে  অনেকগুলো কাক উড়ে গেল। বেশ কিছু অন্যান্য পাখিও উড়লো। আমরা তিনজন ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম ঠিক তখনই গুলি খেয়ে পেটের চামড়া চিরে ভূড়ি বের হয়ে যাওয়া একজনকে দুজন মিলে ভাসিয়ে নিয়ে গেল আমাদের সামনে দিয়ে। এই ঘটনায় আমরা ভিতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি এবং তাৎক্ষনিক ভাবে রাস্তার পাশের প্রাচীর টপকে সবাই একটি বাড়িতে ঢুকে পড়ি। রাস্তার উপর তখন ব্যাপক গোলাগুলি চলছে। সেই বাড়ির একটি ঘরে আমাদের আশ্রয় মেলে। পরে ধীরে ধীরে সেই ঘরটি ভীত সন্ত্রস্ত মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তবে তারা কেউই ফুলবাড়ীর নয়। হয় রংপুরের নয়তো ঢাকা বা অন্য কোন জেলার। শোনা গেল পুলিশ ফুলবাড়ীর বাহিরের লোকজনকেই খোঁজাখুঁজি করছে। ফলে আমরা সন্ধ্যার আগে সেই ঘর থেকে আর বের হতে পারিনি। সন্ধ্যা নামার পর আমরা জানতে পারি কয়েকজন নিহত (পরে জানতে পারি ৩ জন শহীদ হন। তারা ৩জন হলেন তরিকুল, সালেকিন এবং আমিনুল। ৩জনই স্থানীয় এবং কিশোর ও তরুণ বয়সের।) এবং দুই আড়াইশ মানুষ আহত হয়েছেন (পরে রংপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া গুরুতর আহতদের চিকিৎসার তত্তাবধানে  ছিলেন মেডিকেলের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এবং ‘উত্তরাঞ্চল বাঁচাও আন্দোলন’ এর কর্মী হেমন্ত রায় হিম)। সন্ধ্যার পর ঘরে থাকা বিশ/পঁচিশ জনের সবাই আমরা গ্রামের পেছন দিয়ে একটা আলপথ ধরে ফুলবাড়ী স্টেশনে গিয়ে পৌঁছি। গ্রাম পার হওয়ার সময় খেয়াল করলাম একটা বাড়ির ভেতর থেকে এক শিশু গাচ্ছে, কয়লা নিয়ে পালাচ্ছে কে ধর...। রাত ৮টার দিকে আমরা ফুলবাড়ী স্টেশনে পৌঁছাই। তারপর ট্রেনে করে পার্বতীপুর এবং পার্বতীপুর স্টেশনে অর্ধেক রাত ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে শেষরাতে রংপুর স্টেশনে পৌঁছতে সক্ষম হই। এর মধ্যে ২৭ তারিখ থেকে ফুলবাড়ীর মানুষ এশিয়া এনার্জি ও পুলিশ-বিডিআরের বিপক্ষে মারণঘাতী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা এশিয়া এনার্জির দালালদের বাড়ি ঘর ভেঙ্গে দেয়, রাস্তায় গাছ ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করে। পুলিশ প্রহরায় গভীর রাতে ফুলবাড়ী ত্যাগ করে এশিয়া এনার্জির কর্মকর্তারা। সরকারও মাথা নোয়াতে শুরু করে। সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে রাজশাহীর মেয়র, ভূমি উপমন্ত্রী, দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার পার্বতীপুর গেষ্ট হাউজে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ এবং বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাথে বসে চুক্তি স্বাক্ষর করে। কমিটিকে সাথে নিয়ে সরকারী পক্ষ ফুলবাড়ীতে অপেক্ষারত জনতার সামনে এশিয়া এনার্জির সঙ্গে কয়লা চুক্তি বাতিলের ঘোষনা দেন। বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ রক্ষার ইতিহাসে সূচিত হয় একটি নতুন অধ্যায়।

লেখক: কবি ,গদ্যকার ও প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক, আনন্দপাঠ বিদ্যালয়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ