হিন্দু সম্পত্তি আইন সংশোধন প্রসঙ্গে

লিখেছেন আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ

(১) 
একদল লোক দেখলাম হিন্দু আইনে উত্তরাধিকার আইন সংশোধনের বিরোধিতা করে মিছিল বা মানবন্ধন ধরনের একটা কর্মসূচী করছে। করুক। সকলেই তার নিজ নিজ মতামত নানাভাবে জানাবে, এটাই তো কাম্য। তো ওদের একটা বিশাল ব্যানারে দেখলাম লেখা আছে " হে দেবী, হে সনাতনী নারী, এতো শ্রদ্ধা সম্মানের পরও কেন তুমি চাও বাড়ী ও গাড়ী"। এইটা দেখে আমার কাছে বেশ কৌতুক বোধ হলো। বটে! কত সম্মান আর কত শ্রদ্ধা দেওয়া আছে ধর্মে নারীদের জন্যে? 

হিন্দু বিবাহে একটা আচার আছে, অনুষ্ঠানের একটা পর্যায়ে কন্যার পিতা বরের পা ধুইয়ে দেয় আর পায়ে হাত দিয়ে কন্যাকে গ্রহণের জন্যে বরকে কৃতজ্ঞতা জানায়। এই অনুষ্ঠান আমি প্রত্যক্ষ করেছি আমার কলেজের বন্ধুকের বিবাহে। প্রথমবার এর তাৎপর্য তের পাইনি। যখন এখন তাৎপর্য জেনেছি, পরেরবার বিবাহ অনুষ্ঠানের এই পর্বে আমি আর মণ্ডপে থাকতে পারিনি। ক্রোধে অপমানে দুঃখে আমার চোখে জল এসেছে। বিবাহের পাত্রীটি ছিল আমার বন্ধু- কেন? আমি আর আমার বন্ধু আমাদের মর্যাদা কি সমান নয়? নারী হয়েছে বলে আমার বন্ধুটি হীন হয়ে গেছে? সে কি তার পিতার সন্তান নয়? তাকে কেন পিতামাতা বোঝা মনে করবে? 

সনাতন ধর্মে (বা অন্য যে কোন ধর্মে) নারীর মর্যাদা যে কি সেটা তো তসলিমা নাসরিন গ্রন্থসমূহের উদ্ধৃতি দিয়েই লিখেছেন নির্বাচিত কলামে। আর হিন্দু বিধবার অবর্ণনীয় কষ্ট, গ্লানি ও অপমান কি আমরা দেখিনি? এই যদি হয় 'দেবীর' মর্যাদা, দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের নমুনা, তাইলে তো বলতেই হয়, হে আমার সনাতনী বোনেরা, তামদের দেবী হওয়ার দরকার নাই, তোমরা বরং মানুষের মর্যাদার জন্যে লড়াই করো। মানুষ- পুরুষের সমান মর্যাদার মানুষ। এইরকম পূজা, শ্রদ্ধা ও সম্মান চাই না, সমান মর্যাদা চাই- সমান মানে সমান, এক ফোঁটা কম নয় এক ফোঁটা বেশী নয়।    

(২) 
আমার বন্ধু পুলক ঘটককে জোড়হাতে প্রণতি জানাই। পুলক আমার বয়ঃকনিষ্ঠ, কিন্তু যে কাজটায় তিনি নেমেছেন সেটা প্রমাণ করে যে মানুষ হিসাবে তিনি আমার আপনার চেয়ে অনেক বড়, অনেক সাহসী। হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুরুষগুলি (এবং প্যাট্রিয়ার্কির অনুগত দাসী কিছু নারীও) তাকে যেভাবে আক্রমন করে আর যে ভাষায় গালাগালি করে যেসব হুমকি দেয় সেগুলি আমি দেখি মাঝে মাঝে। এগুলি দেখলেই বুঝা যায়, হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সংস্কার চেয়ে যে আন্দোলনটা তিনি করছেন সেটা জগদ্দলে তীব্র আঘাত করেছে। পিতৃতন্ত্রের ভিত কেঁপে গেছে। 

আমি উত্তরাধিকার নিয়ে এই পরিবর্তন বা সংস্কারটা সমর্থন করি। পিতামাতার সম্পদে উত্তরাধিকার কন্যা ও পুত্র সন্তানের সমান হওয়াটাই ন্যায়সঙ্গত- এটাই স্বাভাবিক এটাই প্রাকৃতিক এবং এটাই যুক্তিযুক্ত। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করা অন্যায়। এই বিধান যে ধর্মেরই হোক না কেন, সকল ক্ষেত্রেই এটা অন্যায়। পিতামাতা তার পুত্র ও কন্যাকে সমান দৃষ্টিতে দেখবে, ওদের ত্যাজ সম্পত্তিতে ছেলেমেয়ের অধিকার সমান হবে এটাই যে ন্যায় সেটা কি এতো যুক্তি তর্ক করে বুঝাতে হবে? ভাই বোন সমান সমান পাবে এইটাই তো স্বাভাবিক, এটা নিয়ে তর্ক করতে হবে কেন? 

তর্ক আসে তখনই যখন আপনি পুত্র ও কন্যাকে সমান মনে করবেন না। আপনি যখন মনে করবেন পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়াই স্বার্থকতা বা কন্যা জন্ম দেওয়া মানে হচ্ছে শাস্তি পাওয়া, যখন মনে করবে যে কন্যা সন্তান পুত্রের সমান নয়, তখনই কেবল আপনার কাছে সম্পদে নারীর অধিকার না থাকা বা কম থাকা ন্যায় মনে হবে। নারীকে যদি আপনি মানুষ মনে করেন, পুরুষের সমান মর্যাদার মানুষ, তাইলেই আপনি কি করে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে বৈষম্য মেনে নিবেন? কখনোই সেটা হবে না। 

(৩) 
ধর্মগুলি সব নারীকে ঊন মনে করে, মনে করে যে নারী ঠিক পুর্নাঙ্গ মানুষ নয়, একটু কম মানুষ বা ঊন মানুষ। ধর্মগুলির দৃষ্টিতে কন্যা সন্তান আর মানুষের ব্যবহার্য সম্পত্তির মধ্যে কোন পার্থক্য করে না। সেই জায়গাটায় পরিবর্তন চাই আমরা। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদার আকুতি মনে আছে? 'পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে সে নহি নহি, হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি। যদি পার্শ্বে রাখ মোরে সংকটে সম্পদে, সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে, পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।' আপনি যদি নারীকে আসলেই মানুষ মনে করেন, তাইলে তো আপনিও চাইবেন যে উত্তরাধিকার আইন ও সমাজের সর্বত্র নারীকে পুরুষের সমান মানুষ হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হোক। নাকি? 

পরিবর্তন হবেই। কিছু পরিবর্তন তো হচ্ছে। ভারতে আইন পাল্টেছে। নেপালেও সম্ভবত পাল্টেছে। বাংলাদেশে কেন পরিবর্তন হবে না? নিশ্চয়ই হবে। ব্যক্তিগত পর্যায়েও কিছু কিছু মানুষ নারীর জন্যে অবমাননাকর পুরনো সব নিয়ম অমান্য করছেন। নয়াদিল্লীতে বছর খানেক আগে এক বিবাহের মণ্ডপে গাঁটছড়া বাধার পর সবাইকে অবাক করে দিয়ে বর মাথা নিচু করে কনের পায়ে হাত দিয়ে সম্মান জনাইয়েছে। ছেলেটি বাঙালী, নাম অর্ণব রায়। এরকম ঘটনা কম, কিন্তু ঘটছে মাঝে মাঝেই। ভারতে আরেক বিয়েতে কনের পিতাকে বরের পা স্পর্শ করতে দেয়নি বর, উল্টো সে নিজে সাষ্টাঙ্গ হয়ে প্রণাম করেছে শ্বশুরকে। 

কিন্তু এইসব তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সামগ্রিকভাবে নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো নিতান্ত পিতৃতান্ত্রিক। যেন নারী মোটেই মানুষ হয়- হয় দেবী অথবা দাসী। সনাতনী ভাইয়েরা, আপনার বোনের দিকে তাকান, আপনার স্ত্রীর দিকে, আপনার নারী বন্ধুটির দিকে তাকান। সে কি মানুষ নয়? সে কি তার পিতার সন্তান নয়?

লেখক পরিচিতি: ইমতিয়াজ মাহমুদ, বিশিষ্ট আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ