বাওকুমটা বাতাস যেমন (পর্ব ২)

❑  সুবীর সরকার

৫.
জালছিড়া নদীর কিনারে কিংবা জিঞ্জিরাম নদীর কিনারে আমরা দেখতে পাই ইয়াকুব মুন্সী হেঁটে যাচ্ছেন। তার চোখে এক দূরাগত ভোরের আজান।ঘাড়ের গামছায় মুখ মুছতে মুছতে ইয়াকুব দূরান্তরের
সব দৃশ্যগুলিকে তার স্মৃতি বিস্মৃতির কূহকের ভেতর টেনে আনতে থাকেন। তখন উলিপুরের বিস্তীর্ণ বিলে নেমে যায় অনন্ত সব হাঁসের দল।
এই ১৬ নদীর দেশে, এই চিলমারীর বন্দরের দেশে, এই ব্রহ্মপুত্র বিধৌত জনপদে এভাবেই হেঁটে যেতে থাকে লোকমানুষেরা। তারা জীবনের মধ্য দিয়ে চলাচল করে।তারা নৃত্য গীত বাদ্য বাজনার মিছিলের মধ্যে কখন বুঝি কিভাবে নেমে যায়।
আর কুড়িগ্রাম থেকে একা, খুব একা এক পাখি কিভাবে তার পরিক্রমণ জারি রাখে। সেই পাখি কি শিস দেয় গোপন কান্নার মত! সেই পাখি কি খুব বিমনা হয়ে পড়ে ভুরুঙ্গামারির মেঠোপথে ঘুরে বেড়ানো কচিমুদ্দিনের মরমিয়া গানের সুরে! পাখির ডানার ছায়ায় বিষন্নতা জেগে ওঠে। আর ধরলা নদীর উজানের মাঝির গলায় তখন বাইচের গান জাগে—
“বৈঠা মার বৈঠা মার রে
ও বাইচার ভাইয়া রে
ঝারিয়া বৈঠা মারিয়া যাও রে”

৬.
রংপুরের পাশে হারাগাছের শিথানে মাতব্বরের বিলে একবার বিশাল “এক বাইচের খেলা” দেখেছিল ইয়াকুব মুন্সী। সে এক মারি ফেলা কান্ড!
কত কিসিমের সব নৌকা। রংবেরংয়ের সব নাও। ঝালর পাতা পুষ্প দিয়ে সাজানো।
নাও দৌড়ের কত কত গান বিলের ভাটি আর উজানে জেগে ওঠে, ছড়িয়ে পড়ে বিশ পঞ্চাশ গা গঞ্জে। শাজাহান ওস্তাদ কে আজও খুব মনে পড়ে। বাইচের নৌকার মস্ত এক ওস্তাদ সে।
নৌকার মাঝখানে নাচ গান হাসি তামাশায় সে জমিয়ে দেয় বাইচ খেলা—
“ওরে হাউসের মেলা জোড়া খেলা
ইয়াকুবের বিলতে
ওরে আবদার আলীর 
নৌকা ফাইনালে”
কত কত মানুষের সমাগম বিস্তারিত এক মেলাবাড়িতে রূপান্তরিত হতে থাকে।
সেই মাতব্বরের বিল থেকে সরে আসতে আসতে একসময় স্মৃতির দীর্ঘ যাতায়াতের ভেতর দিনাজপুরের লিচু গাইবান্ধার নারিকেল রংপুরের কাচা গুয়া লালমনিরহাটের নাল গামছা সব কেমন সাজিয়ে রাখা থাকে।
আমাদের ভ্রম বিভ্রমকে অদ্ভুত এক দোলাচলে ঠেলে দিয়ে একসময় মহেন গাড়িয়াল তার মহিষের গাড়ি আর গাড়িয়ালি গান নিয়ে নুতন এক পরিসর রচনা করেই ফেলে কোন একসময়—
“চলে রে মোর ভইসা গাড়ি রে
কাদো পন্থ দিয়া
আরে ধনী বাড়ির কইনাগুলা
দেখি থাকে চায়া রে।”

৭.
ইয়াকুব মুন্সী তো তার এই আয়ুষ্কাল জুড়ে,তার প্রবিণত্বের অভিজ্ঞতায় জীবন জেনেছে। তামাক হাটে প্রবেশ করবার সময় তার তো আর জানা থাকে না প্রস্থানকাল। সে এই পূর্বাপরহীন সংযোগসূত্রহীন এক জীবনের ধন্ধে নিজেকে একপ্রকার ছেড়েই দিতে থাকে।ইয়াকুবের দুচোখে তখন তিস্তা নদীর বিস্তীর্ণ এক বালুবাড়ি জেগে থাকে। দুই কুড়ি আড়াই কুড়ি বছর আগে বড় আব্বার সাথে কতবার তিস্তার চর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তাকে গঙ্গাচড়া, চাপার হাট, ডালিয়া, কাকিনা, কালিগঞ্জ, লালমনি যেতে হয়েছিল।
বড় আব্বা ছিলেন বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের নামিক্কার
গীদাল। ফজলুদ্দীন গীদালকে একডাকে সবাই চিনতো।কত কত মানুষ, গানবাড়ি, মেলাবাড়ি এভাবেই ঘুরে বেড়ানো হয়েছে বাচ্চাতেই। একবার এক পালার আসরে গুপিচন্দ্র আর মূপিচন্দ্র নামে দুই যমজ ভাইয়ের দেখা পেয়েছিল, যারা ছুকরি সেজে খুব রঙ্গরস খুব বাদ্যগীত পরিবেশন করত আর উলিপুরের হাটে গিয়ে হুক্কা তমুক খেত। তখন রংপুরের জমিদার বল, কুন্ডির জমিদার বল, কাকিনা জমিদার বল তাদের কি দাপ কি প্রবল তাপ!
মাঝে মাঝে কোমর জুড়ে জেগে ওঠা দুলুনি নিয়ে গুপী আর মূপি গেয়ে উঠতো—
“ও রে রাজার হস্তিক
পার করিচুং রে”

৮.
মুন্সীবাড়ির জোত ছড়িয়ে নলডাঙ্গার জমিদারবাড়ির দিকে যেতে যেতে বেলা প্রায় ডুবেই গেল। সেই বেলা শেষের আলো সর্বাঙ্গে মাখতে মাখতে রাজেন বৈদ্য একসময় তার বাচ্চা ঘোড়াটির পিঠ ঠেকে নেমেই পড়েন।সেই কত কত সময় ধরে ঘোড়া ও রাজেন বৈদ্য একটা মস্ত সিলুয়েট হয়ে হাটগঞ্জের মানুষের কাছে প্রায় মিথের মর্যাদাই পেয়ে গেছেন। কুড়িগ্রামের পাখি যখন পাটগ্রাম থেকে উড়তে উড়তে পুনরায় ধরলা নদীর উপরেই তার উড়ান জারি রাখে তখন মজিদ মাস্টারের বাড়ির খোলান থেকে ভেসে আসে রাজেন বৈদ্যর মৃদু হাসির শব্দ আর পাশাপাশি তার ঘোড়াটির নিশ্চুপ দাড়িয়ে থাকা।মজিদ মাস্টার বারংবার শোনাতে থাকে পাটগ্রামের যুদ্ধ আর নুরুলদিনের কথা।আর কখন কিভাবে গল্পের ভেতর অনুপ্রবেশ করে জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী আর ইটাকুমারির শিবচন্দ্র রায়।চোখের সামনে এভাবেই রাজেন বৈদ্য এক মস্ত লড়াইয়ের ছবি নির্মিত করে ফেলে তার নিজস্ব মুন্সিয়ানা দিয়েই।
এভাবে জীবন গড়ায়। এভাবে গল্পের পর গল্প জুড়ে জুড়ে কুড়িগ্রামের বগা পংখী অনন্তের এক উড়াল নিয়েই উড়ে যেতেই থাকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ