❏ ইহিতা এরিন
এই পদ্মা এই মেঘনাএই হাজারো নদীর অববাহিকায়এখানে রমণীগুলো নদীর মতো,নদীও নারীর মতো কথা কয়...
ছোটবেলায় গানটা শুনতে শুনতে একটা সময় আমার মনে হতো, বড় হলে আমিও কি হবো নদীর মতন? এই জলের দেশে রমণীরা নাকি নদীর মতো- একথা মাথায় ঢুকে গেছে শৈশব থেকেই.... নদী আর নারী কতটা সমার্থক সেই বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে বরং ছোটবেলা থেকেই আমি কিভাবে প্রচণ্ডভাবে নদীর প্রেমে পড়লাম, সেকথা বলি। অবশ্যই শুধু গান শুনে নয়। আগে নানুবাড়িতে যেতে হতো লঞ্চে চড়ে। মা মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে আমাদের নিয়ে রওয়ানা হতো। প্রচুর নৌকায় চড়া হতো তখন। চারদিকে কি ভরপুর পানি! সূর্যের আলো পড়লে ছোট ছোট ঢেউ গুলো যেন হয়ে যায় হাজার টুকরো সোনার মোহর! আর কত রাশি রাশি কচুরিপানা, সাদা-বেগুনী রঙের কোমল তার ফুল। এই ফুল তুলে নিলে একটু পরেই মরে যায়, যেন জল তার কত জনমের প্রাণের সখা, একটু খানি বিচ্ছেদ তো সঙ্গে সঙ্গে মরণ! আবার কচুরিপানার সবুজ নরম ফাঁপা অংশটা কত খেলায় কাজে লাগানো যেতো... তো যাই হোক, এভাবে করে দিন দিন নদী আমার আপন হতে থাকলো। মনে আছে, যেদিন প্রথম নৌকার ছইয়ে উঠেছিলাম, সে কি আনন্দ! মনে হচ্ছিলো যেন পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছি, হা হা... কখনো কখনো জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে থাকতে কখন যে গন্তব্যে পৌঁছে যেতাম টেরই পেতাম না। তাছাড়া নদীর বাঁধাই করা ঘাট কিংবা সরিষা ক্ষেত আর ধানক্ষেত যেখানে মিশে যেতো নদীর পাড়ে, সেখানে বসে বসে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে কত বিকেল, গোধূলি পার হয়ে রাত নেমেছে, আহা জীবন, আহারে জীবন! বছরে অন্তত কয়েকবার নদীতে যাওয়াই হতো.... সময় পার হতে থাকলো, আমিও বড় হলাম, দিনকাল রাস্তাঘাট হয়ে গেলো আরো আধুনিক, নৌকা আর চলেনা বললেই চলে। তবুও আমার নদীপ্রেম দেখে পায়রা নদীতে গেলেই প্রিয় কেউ কেউ নৌকা ভাড়া করে আমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতো, আমরা মাঝনদীতে ভেসে যেতাম কখনো ভরদুপুরে, কখনো সন্ধ্যায়, রাতে কোজাগরী জ্যোৎস্নায়। সেইসব দিন আমি মিস করি, প্রচণ্ড হাহাকার মেখে মিস করি।
এসবও কতদিন আগের কথা। অনেকগুলো বছর আর নিয়ম করে নদীতে যাওয়া হয়না। প্রিয় যানবানহনের তালিকা বলতে বললে আমার প্রথম তিনটা হলো- নৌকা, লঞ্চ আর রিকশা। সেই নৌকায় চড়া হয়না কতদিন... অথচ আমার ভীষণ ইচ্ছা করে- ভরা বর্ষায় উথাল পাথাল নদীতে নৌকায় ভেসে যেতে, শরতে নৌকায় করে পাড় ঘেঁষে যেতে যেতে অজস্র কাশফুলের কোমলতা ছুঁতে, নৌকার ছইয়ে শুয়ে রাতের আকাশে নক্ষত্রের সলমাজরি দেখতে। আমার আরেকটা ভীষণরকম ইচ্ছে হলো- কোন এক ভরা পূর্ণিমায় নদীর জলে গলে গলে পড়া জোছনা দেখবো আর কেউ একজন পাশে থেকে আওড়াবে জীবনানন্দ-
আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;বলেছিলো: ‘এ নদীর জলতোমার চোখের মত ম্লান বেতফল:সব ক্লান্তি রক্তের থেকেস্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;এই নদী তুমি।’…
এমন একটা অপার্থিব মন কেমন করা ঘটনা এই এক জনমে কোনদিন আমার সাথে হবেনা বোধহয়...
'জল'- এই শব্দটুকুতে যে কি জাদু আছে, মাদকতা আছে, আমি বুঝিনা, সম্মোহিত হয়ে যাই। একটু খানি টলটলে জল দেখলেও আমার মনে হয় এর চেয়ে করুণ সুন্দর আর কিছু নেই...নদী যে আমি কতটা ভালোবাসি তা সহজ করে বুঝাতে বলি- আমি সাগরের চেয়ে নদী বেশি ভালোবাসি... এর উপযুক্ত কোন কারণ দর্শাতে পারবো না, তবে একটা ব্যপার হলো- সুবিশাল সাগরে উচ্ছ্বাস আছে, মুগ্ধতা নিয়ে দেখি; আর নদীর জলে আছে সম্মোহনী এক কোমলতা, নদীর জল বিষণ্ণতা ছড়ায়, মনে হয় যেন কত পথ বয়ে আসতে আসতে সে তার শরীরে জমিয়েছে কত গল্প, কত কাহিনী, হয়তো তা কোন মাঝির, কলসী ডুবিয়ে জল নিতে আসা কোন নারীর, কোন বন্দরের ইত্যাদি। সবুজ করুণ ডাঙার পাশ দিয়ে নদী যেন আদর বুলাতে বুলাতে বয়ে যায় আর আমার মতো কারো কারো চোখে বিষাদের লোনা জল এনে দেয় এই নদীর মিঠেজল.... এমন কোমলতম মায়া নিয়ে বিষাদ ছড়াতে আর কে পারে!
একেকটা নদীর নামও যে এতো মিষ্টি, এতো সুন্দর- ইছামতী, চিত্রা, মধুমতি, ভুবনেশ্বর, রূপসা, ঘাঘট, মহানন্দা, ধলেশ্বরী, সোমেশ্বরী, যমুনা, বংশী, বিপাশা, কাবেরী, অলকানন্দা, জলঙ্গী- আরো এমন অনেক... নাম শুনলেই মনে হয় যেন সেই নদীর কাছে গিয়ে নাম ধরে ডাকি, ডেকে বলি— “নদী, তুমি কোন কথা কও?”… নদীও তো মানুষেরই মতন, জীবনপথের বাঁকে বাঁকে তারও হয় অন্য নদীর সাথে বিচ্ছেদ বা মিলন; “কত আনন্দ বেদনায় মিলন বিরহ সংকটে...” নদীর জল ছুঁয়ে তাকে ভালোবেসে তার সুখ দুঃখের গল্প জানতে ইচ্ছে করে...
আজ অনেকদিন পর নদীতে গেলাম। আবার দেখলাম নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে ছড়ানো সোনার মোহর, বেহুলার ভেলার মতো ভাসতে থাকা সবুজ কচুরীপানা, নদীর বুকে ডুবতে থাকা ডিমের কুসুমের মতো সূর্য; “নাটার মতন রাঙা মেঘ নিংড়ায়ে নিয়ে সন্ধ্যার আকাশ” আহা! রাতের গাঢ় অন্ধকারে জেলে নৌকার টিমটিমে আলো যেন নক্ষত্রের মতন। আর আকাশ জুড়ে সত্যিকারের ঝলমলে অজস্র তারারা তো আছেই, যেন খই এর মতন ফুটে আছে; “আকাশপ্রদীপ জ্বেলে তখন কাহারা যেন কার্তিকের মাস সাজায়েছে..।” কতদিন পর প্রায় অনেকখানি কালপুরুষ দেখলাম। ঊষা, অনিরুদ্ধ আর চিত্রলেখ— একসরল রেখায় ওরা তিনজন একেবারে স্পষ্ট, যদিও কালপুরুষের ধনুকটা তেমন দেখিনি, তবুও সে তো আছে সহস্রকাল ধরে সেভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে পাহারায়, যেন কোন শত্রুর বুকে ছুঁড়ে দেবে বিষাক্ত বাণ!... আর দেখেছি- ঘন হোগল পাতার বন, যেন ঝরে ঝরে পড়ছে নদীর বুকে, অপার্থিব সুন্দর, সুররিয়ালিস্টিক, পৃথিবীরে সত্যিই লেগেছিলো মায়াবী নদীর পারের দেশের মতন…
যতদূর চোখ যায়, এই যে নদী, থই থই জল- আমার মাঝে এমন আশ্চর্য এক বিষণ্ণতাবোধ জাগিয়ে তোলে, আমি এর কারণ জানিনা, শুরু শেষ কিছুই বুঝিনা, শুধু অনুভব করি একটা কান্নাজমা বোধ আমাকে অবশ করে দিচ্ছে। “আমাদের পৃথিবীর বনঝিরি জলঝিরি নদী”, “আমাদের পৃথিবীর পাখালি ও নীল ডানা নদী”— এদেরকে আমি ভালোবাসি। এরা আশ্চর্য এক মোহ নিয়ে আমাকে ডাকে, যেন ডেকে বলে- “যদি গাহন করিতে চাহ, এসো নেমে এসো হেথা গহনতলে…” আমি সাঁতার পারি, ভয় লাগে তবুও নদী আমাকে ভীষণভাবে টানে, আমি তারে পারিনা এড়াতে, প্রতিবার দ্রবীভূত হই টলমলে এক অচিন বিষাদে... তখন আমার চারিপাশে শুধু ভিজে হাওয়া আর সকরুণ জল, তখন “আমার একার জলোৎসবে শুধুই অশ্রুজল...”

0 মন্তব্যসমূহ
প্রাসঙ্গিক ও মার্জিত মন্তব্য করুন