রবীন্দ্রনাথের খাবারকাহিনী


• গদ্যলেন ডেস্ক


কোনো একটি বই নয়, নানা জায়গা থেকে পড়া রবিঠাকুরের খাওয়াদাওয়া নিয়ে এই লেখা। পঁচিশে বৈশাখ কেবল গান গাইলে, কবিতা আওড়ালেই তো হল না, পেটটাকেও তো ঠাণ্ডা করতে হবে? কেননা যাঁর জন্মদিন তিনিই লিখেছেন—

অল্পেতে খুশি হবে
  দামোদর শেঠ কি।
মুড়কির মোয়া চাই,
  চাই ভাজা ভেটকি।

রবীন্দ্রনাথ পেটুক ছিলেন না খাদ্যরসিক সে কূটতর্কে যাচ্ছি না। তবে রসসৃষ্টি নিয়ে তাঁর মনোপলি, সেখানে হাত পড়লেই তিনি নড়েচড়ে উঠতেন। কী ব্যাপার? লেখক বনফুল সপরিবার গেছেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে, শান্তিনিকেতনে কোনো এক বসন্ত উৎসবের সময়। সঙ্গে নিয়ে গেছেন স্ত্রীর হাতে বানানো বাড়ির গরুর দুধে তৈরি সন্দেশ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চা জলযোগের সময় দিলেন সেই সন্দেশ। একটি সন্দেশ মুখে দিয়ে ভাবিত হয়ে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ। 
ক্ষিতিমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, 
‘এ তো বড় চিন্তার কারণ হল।’
‘কেন?’
রবীন্দ্রনাথ তারিয়ে তারিয়ে খেতে খেতে বললেন, ‘বাংলাদেশে তো দুটি মাত্র রস-স্রষ্টা আছে। প্রথম দ্বারিক, দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ যে তৃতীয় লোকের আবির্ভাব হল দেখছি।’

'মৌমাছির মতো আমি চাহি না ভাণ্ডার ভরিবারে
বসন্তেরে ব্যর্থ করিবারে।'

কবিতার নাম মধু। বোধহয় এই কবিতা পড়েই এক রবিভক্ত সত্যি এক বোতল মধু পার্সেল করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তখন মংপুতে। নিবারণ চক্কোত্তির ফর্মে আছেন হয়তো। ডাক্তারবাবু চেকআপ করতে এসেছিলেন, তাঁকে বললেন, ‘দেখেছো তো? মধুর বিষয়ে কবিতা লেখার পর মধু আসছে।’ ডাক্তারবাবুও কম যান না। মন্তব্য করলেন, ‘মধুর কবিতা লিখে যদি মধু আসে, তাহলে মধুর বদলে বধূর কবিতা লিখতে পারতেন।’ 

এরপর কবিকে তেতো ওষুধ গিলতে হয়েছিল কিনা, তাতে মনোদুঃখে তিনি অমিত লাবণ্যকে আলাদা করে দিলেন কিনা সেসব আমরা জানিনা, তবে লেখার সমালোচনা তিনি দিব্যি মনে রাখতেন। তখন তো পাঠ রিভিউ বলে কেবল ভালো ভালো কথা লেখার চল ছিল না কিনা। সেই যে বনফুল সন্দেশ খাওয়ালেন? রবীন্দ্রনাথ বিকেলে আবার ডাকলেন। বনফুলকে বললেন, ‘যাই হোক, বিকেলে কিন্তু চা খাবে। তোমার লেখা পড়ে মনে হয় তুমি ঝাল খেতে ভালোবাস। বিকেলে বড় বড় কাবলে মটরের ঘুগনি করলে কেমন হয়? ঘুগনির মাঝখানে একটা লাল লঙ্কা গোঁজা থাকবে। কী বল?’

ঘুগনি খেতে খেতে তিনি বনফুলকে বলেছিলেন, ‘বনফুল নয়, তোমার নাম হওয়া উচিত ছিলো বিছুটি। যা দু–এক ঘা দিয়েছো তার জ্বলুনি এখনও কমেনি।'

রবীন্দ্রনাথ তরিজুত করে খাওয়াতে পারতেন বটে। প্রথমবার রবীন্দ্রনাথের পালা পড়ল নিজের বাড়িতে 
খামখেয়ালি সভার আড্ডা বসানোর। রথীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘বাবার যেবার নিমন্ত্রণ করার পালা পড়ল, বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেল। মাকে ফরমাশ দিলেন খাওয়ানোর সম্পূর্ণ নতুন রকম ব্যবস্থা করতে হবে। মামুলি কিছুই থাকবে না, প্রত্যেকটি পদের বৈশিষ্ট্য থাকা চাই। ফরমাশ করেই নিশ্চিন্ত হলেন না, নতুন ধরনের রান্না কী করে রাঁধতে হবে তাও বলে দিতে লাগলেন।’ আয়োজনের জন্য জয়পুরের শ্বেতপাথরের বাসন আনানো হল। মাটিতে বসে খাওয়া, কিন্তু খাবার রাখার জন্য প্রত্যেকের সামনে শ্বেতপাথরের একটি করে জলচৌকি থাকবে। খাবারের জায়গা? রথীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘জলচৌকি চতুষ্কোণভাবে সাজিয়ে মাঝখানে যে জায়গা রইল, তাতে বাংলাদেশের একটি গ্রামের বাড়ি বানানো হল। বাঁশবন, শ্যাওলাপড়া ডোবা, খড়ের ঘর কিছুই বাদ গেল না, ছবির মত সম্পূর্ণ একটি গ্রাম। কৃষ্ণনগর থেকে কারিগর আনিয়ে খড়ের ঘর, ছোট ছোট মানুষ, গোরু, ছাগল বানিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হল। এই সুন্দর পরিবেশে নৈশভোজন যে উপভোগ্য হয়েছিল, বলা বাহুল্য।’

এইরকম থিম বানিয়ে আমরা আজকাল দূর্গাপুজো করি, রবিঠাকুর ডিনার করাতেন। সাধে কি নোবেলটা চুরি হয়ে গেছে? অথচ এমনিতে খাবার নিয়ে তিনি ছিলেন যাকে বলে 'আম-আদমি'। আম পাকার সময় জাপান যেতে হবে বলে বাক্সে বরফ টরফ দিয়ে আম বগলে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনিই যে লিখবেন

"আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি, সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে।
হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ, পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।।"

সে আর আশ্চর্য কি!

রবীন্দ্রনাথ খাবার নিয়ে বেশ স্পর্শকাতর ছিলেন বটে। তাঁর বৌঠানের খাওয়ানোর ধরন ছিল আলাদা জগতের। রুপোর রেকাবিতে খোসা ছাড়ানো ফল, নিজের হাতে তৈরি মিষ্টি সাজানো থাকত গোলাপের পাপড়ি দিয়ে। গেলাসে থাকত ডাবের জল বা ফলের রস বা কচি তালশাঁস বরফে ঠান্ডা করা, সমস্তটার উপর একটা ফুলকাটা রেশমের রুমাল ঢেকে মোরাদাবাদি খুঞ্চেতে করে কাদম্বরীদেবী পাঠিয়ে দিতেন কাছারিতে। সে অমৃতের স্বাদ বৌঠানের অকালমৃত্যুর গরল বুঝি মুছে দিতে পারেনি। তাই ফরাসী কায়দার ব্যুফে থেকে ফিউশন খাবার, থিমডিনার থেকে মানকচুর জিলিপি, খাবারের প্রতি ভালোবাসা রবীন্দ্রনাথকে পরতে পরতে জড়িয়ে থেকেছে। কবির আবদারে মৃণালিনী দেবী দিব্যি তৈরি করেছেন মানকচুর জিলিপি, দইয়ের মালপোয়া, পাকা আমের মিঠাই, চিঁড়ের পুলি ইত্যাদি। যখন খামখেয়ালি সভার অধিবেশন থাকতো, তখন কবির ফরমাশ হতো— মামুলি কিছুই থাকবে না, প্রত্যেক পদের বিশেষত্ব থাকা চাই। কবিপত্নীও আশ্চর্য মুনশিয়ানায় সামলে দিতেন সব। শান্তিনিকেতনে থাকার সময়, দোতলার বারান্দায় উনুন পেতে রান্না করতেন মৃণালিনী। সাধারণ গজার নতুন ধরন— পরিবন্ধ, তিনিই প্রথম বানিয়েছিলেন। তাঁকে রাগাবার জন্য রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ‘দেখলে তোমাদের কাজ তোমাদেরকেই কেমন শিখিয়ে দিলুম।’

তা রবীন্দ্রনাথ ঘরকন্না রান্নাবান্নাকে শুধু মেয়েদের কাজ হিসেবেই দেখবেন এ কিছু নতুন কথা তো নয়। তবে কিনা হেঁসেলের আগুন বাইরেও বেরিয়ে আসে। যেমন এলেন প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। ঠাকুরবাড়ির ঘরোয়া রান্নাবান্নাকে লিপিবদ্ধ করার কৃতিত্ব কবির ভাইঝি হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরীর। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশ হয় ‘পুণ্য ’পত্রিকা। প্রথম থেকেই এই পত্রিকার পাতায় পাতায় বিচিত্ররকম আমিষ নিরামিষ রান্নার রেসিপি ছাপা হতে থাকে। প্রজ্ঞাসুন্দরী এইসঙ্গেই জানিয়ে দিতেন তখনকার বাজারদর। তিন বা চার আনায় আধসের পাকা রুই, একটা ডিম এক পয়সা, কুড়িটা টমেটো দুই আনা - যেভাবে বাঙালি তখন খেয়ে বাঁচত। আমজনতার পকেটের খোঁজ নোবেলজয়ী কবি না রাখলেও হেঁসেলের শ্রমিকরা রাখবেন এ আর আশ্চর্য কী?

প্রজ্ঞাসুন্দরী একটি সম্পূর্ণ নতুন জিনিস ভোজসভায় এনেছিলেন— সেটি হল বাংলা মেনু কার্ড বা নির্ঘণ্ট । নিজে তার নাম দিয়েছিলেন ক্রমণী। নিরামিষ ক্রমণী, আমিষ ক্রমণী এমনভাবে লিখতেন, মনে হতো যেন কবিতা। প্রিয় মানুষের নাম জুড়ে দিতেন পদগুলির সঙ্গে। ‘রামমোহন দোলমা পোলাও’, ‘দ্বারকানাথ ফির্নিপোলাও’। বাজারদর আর হেঁসেলের টানাটানিতে উদ্ভাবনা শক্তি হয়ত বাড়ে। বানাতে হবে পেস্তা সন্দেশ, কিন্তু পেস্তার দাম বেশী। ফ্রিতে পেস্তা বিলোবে তেমন দয়ালু কাবলিওয়ালা কেবল কেতাবেই আছে আপাতত। কাজেই কড়াইশুঁটির বিকল্প দিয়ে তৈরী হল গরীবের পেস্তা সন্দেশ, ভালোবেসে নাম রাখা হল বিদ্যাসাগরী সন্দেশ। রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশ বছরের জন্মদিনে স্পেশাল মিষ্টি চাই। ফুলকপি, খোয়াক্ষীর, বাদাম, কিশমিশ, জাফরান, সোনা ও রুপোর তবক দিয়ে  বরফি তৈরি হল, নাম ‘কবিসম্বর্ধনা বরফি’। আজকাল কাব্য উৎসবে যাঁরা কবিদের হাতে মাড়োয়ারী লাড্ডু দিয়ে সেলফি টেলফি তোলেন, পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠানে যাঁরা হলদিরামের ভুজিয়া দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলবেন তাঁরা কি বুঝবেন এর মাহাত্ম্য! কবি এযুগে জন্মালে অবশ্য নিজেই এই বিখ্যাত দোকানগুলির বিজ্ঞাপন লিখে দিতেন না, তার গ্যারান্টি দেব না। ক্যাচলাইন লেখার আর্টে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

জলযোগ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের জন্য লিখেছিলেন, ‘জলযোগের বানানো মিষ্টান্ন আমি চেখে দেখেছি। এটা আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে। এর আলাদা স্বাদ আছে’

রবীন্দ্রনাথ কিন্তু শুধু দিশী পণ্যের বিজ্ঞাপনই করেননি। তাঁকে বিদেশী বোর্ণভিটার বিজ্ঞাপনেও দেখা গিয়েছে। লিখেছেন, ‘বোর্ণভিটা সেবনে উপকার পাইয়াছি’।

শ্রীঘৃত নিয়ে লিখেছিলেন  ‘বাংলায় ঘিয়ের ভেজাল বাঙালির অন্ত্রের ভেজালকেও অনিবার্য করে তুলেছে। আমি আশা করি শ্রীঘৃত বাঙালির এই ভেজাল রোগের প্রতিকার করবে’।

মিষ্টির কথা দিয়েই শেষ করি, মধুরায়েন সমাপয়েৎ। 
মংপুতে মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে কবি আব্দার ধরলেন  মারমালেড দিয়ে ছাতু মেখে সবাইকে খাওয়াবেন। 
সকলে আঁতকে উঠলেন। কবির এক গোঁ।
"আনাও না ছাতু। এক সময়ে ভালো ছাতু মাখিয়ে বলে আমার নাম ছিল, মেজদার টেবিলে মারমালেড দিয়ে ছাতু মাখতুম"।
অতএব খোঁজ শুরু হল ছাতুর। কিন্তু যবের ছাতু মিলল না। শেষে মুড়ির ছাতু পাওয়া গেল। রবিবাবু বললেন -"বেশ তাতেই হবে।" তারপর মারমালেড, গোল্ডেন সিরাপ, আদার রস, দুধ, কলা, মাখন দিয়ে প্রায় আধঘন্টা ধরে ছাতু মাখতে লাগলেন তিনি। সন্ধ্যেবেলা ছাতু মাখা শেষ হল। এবারে খাবার পালা। কবি নিজেই সবাইকে প্লেটে প্লেটে বেড়ে দিলেন। তা মুখে তুলেই সবাই বুঝল স্বাদ মোটেই সুবিধের নয়। মৈত্রেয়ী দেবীকে জিজ্ঞেস করলেন রবীন্দ্রনাথ -" কি কিরকম?"
মৈত্রেয়ী দেবী হেসে বললেন-" চমৎকার! এতো রোজ খেলেই হয়"
ও হাসির অর্থ বুঝবেন না তেমন বান্দা তো ক্যামেলিয়ার কবি নন। ঠোঁট উল্টে বললেন, "তোমাদের ছাতুর দোষ গো, ছাতুর দোষ, তা না হলে ভালো না হয়ে যায়ই না!"

অতএব ঐ ছাতুমাখা হল গিয়ে দেবভোগ্য। পারলে পরশু প্রসাদ চড়াবেন। ছবিতে আমাদের প্রসাদ।
বেনারস নিয়ে প্রচুর গম্ভীর আলোচনা করেছেন কবি। কোথাও বেনারসের রাবড়ির কথা শুনিনি। তাই জন্মদিনে রইল বিশ্বনাথ গলির পাগল সর্দারের বিখ্যাত রাবড়ির ছবি।

তথ্যসূত্র:
আমিষ ও নিরামিষ আহার তিন খণ্ড - প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী
জীবনস্মৃতি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পিতৃস্মৃতি - রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল - চিত্রা দেব
বঙ্গদর্শন এবং এইসময়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ