বাওকুমটা বাতাস যেমন (পর্ব ৪


• সুবীর সরকার

১২.
মাধাইখালির কালী মেলার মাঠের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ইয়াকুব মুন্সীর দুই চোখে নুতন করে জেগে ওঠে হেমন্তের সোনা রোদে ভেসে যাওয়া মাঠ প্রান্তর পাথারের ম্যাজিক।এখন মধ্য অঘ্রান।মাঠ শূন্য করে সোনালী ফসল এখন গেরোস্তের মাটি লেপা খোলানে। হেউতি ধানের আঘ্রানে শরীর মনে অদ্ভুত এক পুলক জাগে।ইয়াকুব এগোতে থাকেন ভুরুঙ্গামারী বন্দরের দিকে।সেখানে অপেক্ষায় আছে গফুর আলী,কদম মিঞা,ভূষণ বর্মণেরা।আজ রাতে কৃপাসিন্ধু গীদালের দলের কুশান যাত্রার আসরে সবাই মিলে যাওয়া হবে। আগিলা দিনের কত কত কথা হবে।তারপর কাল যাওয়া হবে মুন্সীরঘাট।সেখানে ব্রজসুন্দর অপেরার যাত্রা হবে।সিরাজদ্দৌলা পালা। ডে লাইট, হ্যাচাকের আলোয় ভরে উঠবে গানবাড়ি।হয়তো কোমরে নাচের ঝাঁকুনি নিয়ে কদম মিঞা গফুর আলিরা গেয়ে উঠবেন_
"কইনা হামার বসি থাকে
ভরা সভার মাঝতে
এল্যা দুলা দে দে তুই
হ্যাচাকের বায়না রে"

এই দৃশ্যখন্ডের ভেতর অবধারিত প্রবেশ করবেন ইয়াকুব মুন্সী।গান নাচের এই দিনদুনিয়ায় অবধারিত উড়ে যেতে থাকবে ধরলা পারের বগা পংখীর ঝাঁক।উড়ে যাওয়া সেই পাখিদের ডানার ছায়ায় জনপদের পর জনপদে জেগে উঠতে থাকবে অগণন মিথ।

১৩.
হাঁটাচলা দিয়েই তো মানুষ বড় কোন হাটের মধ্যে ঢুকে পড়ে।কিংবা হাটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে।আসলে হাঁটাচলা দিয়েই মানুষকে তার নিজের জীবনটাকে যাপন করতে হয়।যাপিত জীবনের অন্দর বাহিরে মানুষের আশ্চর্য এক নিরাসক্তি তাকে জীবনের কোন এক কুহকের দিকেই চিরকালের মতন ঠেলে দেয়!
এই সব ভাবতে ভাবতে গোকুল ডাক্তার বাড়ি ফিরতে থাকে।আজ তাকে যেতে হয়েছিল শহর কুড়িগ্রাম।
জিতেন ধনীর বাসায়।অসুস্থ জিতেন ধনীকে ওষুধপাতি দিয়ে ধরলা নদীর কিছুটা উজানে রতিকান্ত বয়াতির খামারে দুপুরের ভোজ সেরে খিলি পান মজা গুয়ার তীব্র আমেজে ডুবে যেতে যেতে
একের পর এক তাকে শুনে যেতে হয়েছিল সিরাজউদ্দিন গিদালের ভাওয়াইয়া গান।কুড়িগ্রামকে
মাঝখানে রেখে ১০০/১৫০  মাইল জনপরিধির ভেতর সকলেই এক ডাকে চেনে সিরাজ গীদালকে।
হাট বল মেলা বল জলসা বল বিয়াও বাড়ি বল সবখানেই সিরাজ গিদাল তার শিষ্য দের নিয়ে গান নিয়ে বাদ্য নিয়ে বাজনা নিয়ে ঢোল নিয়ে বাঁশি নিয়ে
ঘুরে বেড়ায়।হেমন্তের নরম হয়ে আসতে থাকা রোদের মায়া শরীরে মাখতে মাখতে গোকুল ডাক্তার শুনতে থাকে গান_
"ওরে গান গান করিয়া সব্বনাশ
তেও না মেটে মোর গানের হাউস
ওরে গান করং 
হামরা গাওয়াইয়া"

মহিষের গাড়ির দুলুনিতে ডুবে মরতে মরতে গোকুল ডাক্তার তার বাড়ি ফিরবার পর্ব পর্বান্তর কে নিজের
মতন করেই সাজাতে থাকেন।

১৪.
জয়নুল খালার রাত জেগে বানানো চন্দ্রপুলি পিঠের স্বাদ সমস্ত শরীরে পুলক এনে দিলে আজাহার মাস্টার হেমন্তের এই ভোরে কুয়াশার আবছা জালের পরপার থেকে স্মৃতি থেকে খুলে ধরেন কিতাব।
কিতাব থেকে তিনি তুলে আনেন নুরুলদিনের যুদ্ধের কিচ্ছা।সেই কবেকার কৃষক বিদ্রোহ।মন্ত্রী দয়াশীল।জয়দূর্গা দেবী চৌধুরানী, শিবচন্দ্রের গল্প।
তির ধনুক বাঁশের লাঠি নিয়ে ছুটে চলা কৃষকদের পায়ের শব্দে উড়ে যাওয়া সব পাখিদের গল্প।
আজাহার মাস্টার বলতে থাকেন লাল বাই,লালমনির হাট,আওলিয়ার হাট আর পাটগ্রামের লড়াইয়ে মরে যাওয়া নুরুলদিনের কথা।আচ্ছা এই সব গল্প নিয়ে কি কুড়িগ্রামের কুরুয়া পাখি তার ঠোঁটে করে উড়ে যাবে মহাস্থান করতোয়া যমুনার উজান ভাটিতে যেখানে মুস্কিল আসানের ন্যাম্ফো জ্বালিয়ে কেরামত হুজুরের মাজারে অপেক্ষায় আছেন মজনু শাহ, মুসা শাহ।আর চারপাশে বেজেই চলতে থাকবে ক্যাপ্টেন টেলরের বন্দুকের গুলির শব্দ 
এত এত গল্পের জাড় থেকে ফিরে আসতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আজাহার মাস্টার শুনতে পান আন্ধন ঘর থেকে হালকা বাঁশির সুরের মত ভেসে আসছে জয়নুল খালার গান_
"আরে নালমনিরহাট হামার বাড়ি
কাঞ্চা বয়সের মুই নারী
কায় দেখে মোর
মুখের ভিতি চায়া"
আর উঠোন জুড়ে বিছিয়ে পড়তে থাকে রোদ ভরা হেমন্তের সকাল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

প্রাসঙ্গিক ও মার্জিত মন্তব্য করুন